**২০২৬: একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর? বিশ্ব মঞ্চে অস্থিরতার আভাস**
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা যখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (United Nations General Assembly – ইউএনজিএ) মিলিত হচ্ছেন, তখন সবার নজর বর্তমান সংকটগুলোর দিকে—গাজা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুটি সংঘাত সম্ভবত ২০২৬ সাল পর্যন্ত চলবে।
তবে, জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে প্রায়ই এমন কিছু বিষয় চাপা পড়ে যায়, যা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক এবং সিএনএন-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক ব্র্রেট ম্যাকগার্কের মতে, ২০২৩ সালের ইউএনজিএ-তে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হামাস ইসরায়েলে হামলা চালাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
একইভাবে, ২০১৯ সালে কেউ ভাবেনি যে শীঘ্রই একটি বৈশ্বিক মহামারী আমাদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে।
ম্যাকগার্ক মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে মনে হয়, বিশ্বজুড়ে এখন যা ঘটছে, তা হয়তো আরও বড় কোনো ঘটনার পূর্বাভাস।
গাজায় চলমান সংকট:
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য প্রথমে একটি তিন-পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাসেই সেই চুক্তি ভেস্তে যায়।
এরপর থেকে আলোচনা কার্যত থমকে গেছে, মানবিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে এবং ইসরায়েলি সামরিক অভিযানও বেড়েছে। বর্তমানে, গাজায় সংঘাতের অবসানের কোনো লক্ষণ নেই।
অন্যদিকে, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মতো কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে। তবে তাদের এই পদক্ষেপ হামাসকে অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারবে না।
বরং এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এমনটা হলে ইসরায়েল ওয়েস্ট ব্যাংকে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে এবং হামাস তাদের অবস্থানে আরও অনড় থাকবে।
ইউক্রেন সংকট:
ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতেও দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন। প্রথমে একতরফা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।
ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে আবার তা পুনরায় চালু করা হয়েছে। একইসাথে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেওয়া হলেও, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিউইয়র্কে আসন্ন সম্মেলনে গাজা ও ইউক্রেন নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, তবে এই সংকট সমাধানে সহায়ক কোনো পদক্ষেপ আসার সম্ভাবনা কম।
বৈশ্বিক জোট এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ:
অন্যদিকে, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে (যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন-কে একসঙ্গে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে ছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিও।
এই জোট—চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া (সংক্ষেপে ‘ক্রিংক’ নামে পরিচিত)—কেবল প্রতীকী নয়, বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে সেনা পাঠিয়েছে। ইরান রাশিয়াকে ড্রোন সরবরাহ করেছে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরেই ইরানি প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চীন রাশিয়ান জ্বালানির বৃহত্তম ক্রেতা হিসাবে যুদ্ধের জন্য অর্থ যোগান দিচ্ছে এবং দেশটির অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই ঘটনার জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে এবং উন্নত সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটবে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেইজিং সম্মেলনের ছবি দেখে বলেছিলেন, “তারা চাচ্ছিল আমি যেন এটা দেখি।” তিনি আরও বলেন, “আমি ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং-উনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।”
যদি ক্রিঙ্ক জোট শক্তিশালী হতে থাকে এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের খরচ কমে যায়, তাহলে তাইওয়ানের প্রতি চীনের আগ্রাসী মনোভাব আরও বাড়বে।
ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং কোরীয় উপদ্বীপে উত্তর কোরিয়ার অস্থির আচরণও বাড়তে পারে।
অতএব, ২০২৬ সাল সম্ভবত একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে যাচ্ছে। এই বছরটি বিশ্ব একত্রতা ও স্থিতিশীলতার দিকে যাবে নাকি বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত বাড়বে, তা নির্ভর করবে বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপের ওপর।
যদি ক্রিঙ্ক জোটের দেশগুলোর আগ্রাসন কমে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির জোটগুলো—যেমন ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ফিলিপাইন—আরও শক্তিশালী হয়, তাহলে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) ক্ষেত্রে চলমান প্রতিযোগিতা এবং ইউক্রেন ও গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে বিশ্ব নিরাপত্তা এবং আমেরিকার অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
অতএব, ২০২৩-২৫ সালের মধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো ২০২৬ সালের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন