খেরসনে ড্রোনের ‘ভয়ংকর শিকার’: পথে প্রান্তরে আতঙ্ক!

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের খেরসন শহর: আতঙ্কের জনপদ

খেরসন, ইউক্রেনের একটি শহর। এখানকার মানুষজন এখন এক বিভীষিকাময় জীবন যাপন করছে।

রাশিয়ার সীমান্তবর্তী এই শহরটিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র যে, দিনের আলোতেও সেখানে নীরবতা বিরাজ করে। শহরের প্রধান চত্বর প্রায় জনশূন্য।

রাস্তাঘাটে যানবাহনের আনাগোনাও তেমন নেই। মাঝে মাঝে হাতে লাঠি ভর করে কোনো বৃদ্ধা অথবা সাইকেল আরোহীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাজার করতে যেতে দেখা যায়।

খেরসন শহরটি এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলা যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে অবস্থিত। এখানকার বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়।

কারণ, রাশিয়ান সেনারা তাদের খুব কাছেই, ডিনিপ্রো নদীর ওপারে অবস্থান করছে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে জীবনহানির আশঙ্কা লেগেই আছে।

স্থানীয় একটি মুদি দোকানে গেলে দেখা যায়, দোকানের প্রবেশপথে বড় আকারের ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। কাঁচের দরজাগুলো কাঠের তক্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

দোকানে আসা বাসিন্দাদের অধিকাংশই বয়স্ক নারী ও পুরুষ। তারা কোনোরকমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরে যান।

একসময় খেরসন ছিল রাশিয়ান বাহিনীর প্রথম আক্রমণের শিকার হওয়া একটি প্রধান শহর। আট মাস পর যখন শহরটি মুক্ত হয়, তখন নীল-হলুদ পতাকা হাতে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

তারা সৈন্যদের জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে এবং গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।

আজও শহরের বিভিন্ন স্থানে ইউক্রেনের পতাকা উড়তে দেখা যায়। তবে শহরের সেই কোলাহল আর আনন্দের চিহ্ন এখন আর নেই।

সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় খেরসন শহরের মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়, যার ফলে খেরসনসহ কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার হয়।

২০২২ সালে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর মস্কোর সেনারা আরও বেশি অঞ্চল দখল করে নেয়।

শহরের অনেক বাড়িতে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বিদ্যমান। বোমা হামলায় ঘরবাড়ির জানালা ভেঙে গেছে, ভবনগুলোর বিভিন্ন অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

আকাশে এখনো অবিরাম গোলাগুলি চলছে, যা আঘাত হানলে বিকট শব্দ হয়। তবে বর্তমানে এখানকার মানুষের কাছে সবচেয়ে ভয়ের কারণ হলো ড্রোন।

ওলেনা ভাসিলিয়েভনা শিগারেভা নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “ড্রোন কতটা ভয়ংকর, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটি ওড়ে, শব্দ করে, কিন্তু দেখা যায় না।

যখন দেখা যায়, তখন সেটি অনুসরণ করতে শুরু করে।”

শিগারেভা আরও জানান, তিনি এবং অন্য একজন নারী যখন হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের ওপর ড্রোন হামলা চালানো হয়। স্থানীয়রা এটিকে ‘শিকার অভিযান’ বলে অভিহিত করেন।

টেলিগ্রাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, সশস্ত্র ক্যামেরা ড্রোনগুলি কীভাবে বেসামরিক নাগরিকদের তাড়া করে এবং বিস্ফোরক ফেলে।

শিগারেভা বলেন, “তারা দেখতে পাচ্ছিল আমরা নারী, কোনো সেনা নই। আমরা তাদের কোনো ক্ষতি করিনি। এটা কেবলই বিভীষিকা।

বর্তমানে শিগারেভা একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার হাঁটুতে গুরুতর আঘাত লেগেছে এবং পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে।

হাসপাতালটিতে আহতদের চিকিৎসা চলছে। সেখানকার কর্মীরা নিরলসভাবে যুদ্ধাহতদের সেবা করে যাচ্ছেন।

আহতদের মধ্যে অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক, যারা ড্রোন হামলার শিকার হয়েছেন।

হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। সেখানে একজন বৃদ্ধ মহিলার পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, এক কিশোর বাসের ওপর ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে এবং এক ব্যক্তির দুটি পা-ই অস্ত্রোপচার করে ফেলতে হয়েছে।

খেরসন শহরের মেয়র রোমান ম্রোচকো একটি বেসমেন্টে বসে কাজ করেন। তিনি জানান, প্রতিদিন তার শহরে প্রায় ১০০টির মতো ড্রোন হামলা হয়।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক ড্রোনকে ভূপাতিত করতে সক্ষম হলেও, কিছু ড্রোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারছে।

আমরা এটিকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা হিসেবে দেখছি। রাশিয়া নতুন ড্রোন ইউনিট পাঠাচ্ছে এবং তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক আইনে বেসামরিক অবকাঠামো এবং যুদ্ধে সরাসরি জড়িত নয় এমন বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইউক্রেন, পশ্চিমা মিত্র, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বারবার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও রাশিয়া এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

শহরের পূর্বাঞ্চলে ড্রোন হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। সেখানকার বাসিন্দারা কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

দিনের শুরুতে যখন একটু নীরবতা থাকে, তখন স্বেচ্ছাসেবকরা একটি ট্রাকের পেছনে করে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে সেখানে যান।

মহিলারা ভয়ে ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ত্রাণ গ্রহণ করেন।

এরপর দ্রুত তারা ঘরে ফিরে যান। কারণ, বাইরে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়।

aidকর্মীরা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শেষে তাদের আশ্রয়ে ফিরে যান।

এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিএনএনের প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ক্লারিসা ওয়ার্ড, সিনিয়র প্রযোজক ব্রেন্ট সোয়েলস, ফটোসাংবাদিক স্কট ম্যাকউইনি এবং সাংবাদিক কোস্টা গাক।

প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওয়ার্ড, সোয়েলস এবং রাচেল ক্লার্ক।

তথ্য সূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *