বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। যাদের অনেকের জন্য জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন।
কিন্তু পর্যাপ্ত হৃদযন্ত্রের অভাবে অনেক রোগী এই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। উন্নত বিশ্বে এই সমস্যার সমাধানে অন্য প্রজাতি থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে, যা ‘জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন’ নামে পরিচিত।
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল চিকিৎসক শূকরের হৃদযন্ত্র মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ডাক্তার মোহাম্মদ মনসুর মহিউদ্দিন এই গবেষণার অগ্রদূত। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা কয়েক বছর আগে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়া এক রোগীর দেহে শূকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করেন।
ডেভিড বেনেট সিনিয়র নামের ওই রোগী দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে তাঁর হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন সম্ভব ছিল না।
তাই চিকিৎসকরা শূকরের হৃদযন্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শূকরের হৃদযন্ত্রকে মানুষের শরীরের উপযোগী করে তোলা হয়, যাতে প্রতিস্থাপনের পর তা সহজে গ্রহণ করা যায়।
অস্ত্রোপচারের পর বেনেট প্রায় দুই মাস জীবিত ছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁর শরীরে নতুন হৃদযন্ত্রটি প্রত্যাখ্যানের কারণে তিনি মারা যান।
২০২৩ সালে, লরেন্স ফসেট নামের আরেকজন রোগীর শরীরে একই পদ্ধতিতে শূকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়। এই রোগী অস্ত্রোপচারের ৪০ দিন পর মারা যান, কারণ তাঁর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন অঙ্গটিকে গ্রহণ করতে পারেনি।
তবে, প্রতিটি অস্ত্রোপচার, এমনকি ব্যর্থতাও ডাক্তার মহিউদ্দিন ও তাঁর দলের জন্য নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, এই ধরনের গবেষণা তাঁদের সফলতার আরও কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
তাঁদের লক্ষ্য হলো এমন একটি বিশ্ব তৈরি করা, যেখানে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে, কোনো রোগীই যেন অঙ্গের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন।
শূকরের হৃদযন্ত্র ব্যবহারের আগে, ডাক্তার মহিউদ্দিন ইঁদুর, বানর এবং শিম্পাঞ্জির হৃদযন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে এইডস (HIV) সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায়, তা মানুষের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
এছাড়া, শিম্পাঞ্জির হৃদযন্ত্র মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় আকারে পৌঁছতে প্রায় ২০ বছর সময় লাগে। শূকর এই ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপযোগী।
একটি শূকরীর শরীর থেকে একসঙ্গে ১০টির বেশি বাচ্চা পাওয়া যায় এবং তাদের দ্রুত বড় করা সম্ভব।
ডাক্তার মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, শূকরের হৃদযন্ত্র মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য তাদের জিনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রটিকে মানুষের শরীর সহজে গ্রহণ করতে পারে।
শূকরের প্রায় ৩০,০০০ জিনের মধ্যে মাত্র ১০টিতে পরিবর্তন আনা হয়। এছাড়াও, শূকরের হৃদযন্ত্র মানুষের শরীরে বসানোর পর যেন অতিরিক্ত বৃদ্ধি না পায়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়।
প্রতিস্থাপনের পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যা নতুন হৃদযন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানের সম্ভাবনা কমায়।
অনেকের মনে শূকরের অঙ্গ ব্যবহার নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে। তবে ডাক্তার মহিউদ্দিনের মতে, জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে অন্য সব বিষয় গৌণ।
মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক