যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক তীর্থযাত্রা পথ: আত্মানুসন্ধানের এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
একসময় তীর্থযাত্রা ছিলো ধর্মীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, পবিত্র স্থানে ভ্রমণ করে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদন করা। বর্তমানে, এই ধারণাটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।
এখন অনেকেই তীর্থযাত্রাকে দেখেন আত্মানুসন্ধান এবং মানসিক প্রশান্তির পথ হিসেবে, যেখানে ধর্ম মুখ্য বিষয় নাও হতে পারে। যুক্তরাজ্য একটি বহু-সংস্কৃতির দেশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষের বসবাস।
এখানে তাই তীর্থযাত্রার ধারণাটিও সময়ের সাথে সাথে নতুন রূপ নিয়েছে। এটি এখন শুধু ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসারও সুযোগ তৈরি করে।
মধ্যযুগের পর যুক্তরাজ্যে তীর্থযাত্রার জনপ্রিয়তা আবার বেড়েছে। সম্ভবত এর কারণ হলো আধুনিক জীবনের জটিলতা থেকে দূরে, প্রকৃতির কাছাকাছি কিছু সময় কাটানো।
যেখানে একটানা হাঁটা, বিশ্রাম নেওয়া এবং প্রকৃতির নীরবতা উপভোগ করা যায়। এটি এক ধরনের সুস্থ জীবনযাপনের অনুষঙ্গ, যা দ্রুতগতির একবিংশ শতাব্দীর জীবনের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
আসুন, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তীর্থযাত্রা পথের সাথে পরিচিত হই:
১. গোল্ডেন ভ্যালি পিলগ্রিম ওয়ে, দক্ষিণ-পশ্চিম হিয়ারফোর্ডশায়ার:
এই পথটি একটু ভিন্ন ধরনের। প্রায় ৬০ মাইল দীর্ঘ এই পথ কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যায় না, বরং হিয়ারফোর্ডের একাদশ শতাব্দীর ক্যাথেড্রালের দরজা থেকে শুরু হয়ে আবার সেখানেই শেষ হয়।
পথের মাঝে রয়েছে নয়টি গির্জা, যেখানে তীর্থযাত্রীরা রাতে বিশ্রাম নিতে পারেন। প্রতিটি রাতে থাকার জন্য প্রায় ২০ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২,৮০০ টাকা) খরচ হতে পারে।
এখানকার ম্যাডলি চার্চ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে আসছে। এছাড়াও, এখানে হিয়ারফোর্ড ক্যাথেড্রালের সন্ন্যাসীদের বিশ্রামাগারেও থাকার সুযোগ আছে, যা মধ্যযুগের পর থেকে তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি বিরল অভিজ্ঞতা।
২. সেন্ট কাঠবার্টস ওয়ে, স্কটিশ বর্ডার ও নর্দাম্পটনশায়ার:
সপ্তম শতাব্দীর সাধু সেন্ট কাঠবার্টের স্মৃতি বিজড়িত এই পথটি প্রায় ৬২ মাইল দীর্ঘ। এটি স্কটিশ সীমান্তের মেলরোজ শহর থেকে শুরু হয়ে হলি আইল্যান্ডে শেষ হয়েছে।
১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এই পথটি তীর্থযাত্রী ও প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। পথের মাঝে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান, যা এই যাত্রাপথকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
৩. সেন্ট প্যাট্রিকস ওয়ে, কাউন্টি আর্মাঘ ও কাউন্টি ডাউন:
আয়ারল্যান্ডের এই তীর্থযাত্রা পথটি তুলনামূলকভাবে নতুন, যা ২০১৫ সালে চালু হয়েছে। ৮২ মাইল দীর্ঘ এই পথে রয়েছে নাভান ফোর্ট এবং ডাউনপ্যাট্রিক শহর, যা আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্টধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
এই পথে সবুজ ও সুন্দর প্রকৃতি, খাল, এবং পর্বতমালা পরিবেষ্টিত। এখানে তীর্থযাত্রীরা তাদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারেন এবং ডাউনপ্যাট্রিকের সেন্ট প্যাট্রিক সেন্টার থেকে একটি সনদও পান।
৪. কর্নিশ সেল্টিক ওয়ে, কর্নওয়াল:
ষষ্ঠ শতকে এই অঞ্চলে সাধুদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের স্মৃতি আজও বিদ্যমান। কর্নিশ সেল্টিক ওয়ে তারই প্রতিচ্ছবি।
১২৫ মাইল দীর্ঘ এই পথে সেন্ট জার্মান্স থেকে সেন্ট মাইকেল মাউন্ট পর্যন্ত ভ্রমণ করা যায়। এখানে পুরনো ক্রস, পবিত্র কুয়াসহ প্রাচীন খ্রিস্টানদের নানা নিদর্শন দেখা যায়।
এই পথে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যও ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করে।
৫. ওয়েক্সফোর্ড-পেমব্রোকশায়ার ট্রেইল, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলস:
১৬২ মাইল দীর্ঘ এই পথটি দুটি সেল্টিক অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশ্রণ। সেন্ট এইডানের ষষ্ঠ শতাব্দীর যাত্রা অনুসরণ করে এই পথ তৈরি করা হয়েছে।
এটি আয়ারল্যান্ডের ফার্নস-এর পবিত্র কুয়া থেকে শুরু হয়ে ওয়েলসের সেন্ট ডেভিডসে শেষ হয়। এই পথে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, যেমন – সেন্ট ডেভিডস ওয়েল, আওয়ার লেডি’স আইল্যান্ড-এর মতো স্থানগুলো ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে।
৬. দ্য ওল্ড ওয়ে, দক্ষিণ ইংল্যান্ড:
২৪০ মাইল দীর্ঘ এই তীর্থযাত্রা সাউদাম্পটন থেকে ক্যান্টারবুরি পর্যন্ত বিস্তৃত। চতুর্দশ শতাব্দীর একটি মানচিত্রের সূত্র ধরে তৈরি হওয়া এই পথটি ব্রিটিশ পিলগ্রিমেজ ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে আধুনিক রূপ পেয়েছে।
এখানে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, যেমন – টিচফিল্ড অ্যাবে, চিচেস্টার ক্যাথেড্রাল এবং প্রাচীন পথগুলি দেখা যায়। এই পথে বিভিন্ন আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের আয়ের উৎস হিসেবেও কাজ করে।
৭. নর্দার্ন সেন্টস ট্রেইলস, কাউন্টি ডারহাম:
২০২১ সালে চালু হওয়া এই পথগুলো উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসকে তুলে ধরে। এখানে সেন্ট কাঠবার্ট, ভেনারেবল বেদে-এর মতো ব্যক্তিত্বদের স্মৃতি বিজড়িত পথ রয়েছে।
এই পথগুলো ধর্মীয় ইতিহাসের পাশাপাশি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দেয়।
যুক্তরাজ্যের এই তীর্থযাত্রা পথগুলো কেবল ভ্রমণের সুযোগ নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মানুসন্ধানের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
যারা জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চান এবং প্রকৃতির কাছাকাছি কিছু সময় কাটাতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই স্থানগুলো হতে পারে আদর্শ গন্তব্য।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক