টেনিস খেলোয়াড়দের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নতুন মোড় নিলেন নোভাক জোকোভিচ। বিশ্ব টেনিস অঙ্গনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এবার আইনি পদক্ষেপ নিলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের সংগঠন।
মঙ্গলবার (বর্তমান তারিখ অনুযায়ী) এই খবর প্রকাশ হয়েছে, যেখানে জানা যায় পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়দের সংস্থা (PTPA) বিশ্বের বিভিন্ন আদালতে মামলা করেছে। খেলোয়াড়দের স্বার্থকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং টেনিসের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ আনা হয়েছে এই মামলায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের একটি আদালতে দায়ের করা মামলায় অ্যাসোসিয়েশন অফ টেনিস প্রফেশনালস (ATP), ওমেন’স টেনিস অ্যাসোসিয়েশন (WTA), ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন (ITF) এবং ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ইন্টিগ্রিটি এজেন্সির (ITIA) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। পিটিপিএ-এর পক্ষ থেকে এই সংস্থাগুলোকে একটি “কার্টেল” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যেও মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিউ ইয়র্কে দায়ের করা ১৬৩ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি এরই মধ্যে সংবাদ সংস্থা সিএনএন-এর হাতে এসেছে।
মামলার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে পুরস্কারের অর্থ, র্যাঙ্কিং পদ্ধতি, খেলার সময়সূচি, আইটিআইএ-এর তদন্ত প্রক্রিয়া এবং খেলোয়াড়দের নাম, ছবি ও পরিচিতি ব্যবহারের (NIL) ক্ষতিপূরণসহ আরও অনেক বিষয়। মামলার বাদী হিসেবে রয়েছেন ১২ জন খেলোয়াড়।
তাঁদের মধ্যে পিটিপিএ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ভ্যাসেক পসপিসিল এবং ২০২২ সালের উইম্বলডন ফাইনালিস্ট নিক কিরগিওস অন্যতম। নিউ ইয়র্কের আদালতে এই মামলার শুনানিতে জুরিবোর্ড চেয়েছেন বাদীরা।
পিটিপিএ-এর নির্বাহী পরিচালক আহমাদ নাসার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “টেনিস এখন ভাঙা অবস্থায় আছে।
সংস্থাগুলো খেলোয়াড়দের স্বার্থকে দূরে সরিয়ে রেখে তাদের প্রতিভা শোষণ করছে, আয়ের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে এবং খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করছে।
আমরা আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের চেষ্টা করেছি, কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আমাদের আর কোনো সুযোগ রাখেনি, তাই আদালতের দ্বারস্থ হতে হলো।
এই পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো দূর করা টেনিসকে ধ্বংস করার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেলোয়াড় এবং ভক্তদের জন্য একে বাঁচানোর জন্যই জরুরি।”
এ বিষয়ে এটিপি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা পিটিপিএ-এর দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে এবং মনে করে এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই।
তারা তাদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে।
এটিপি আরও জানায়, ১৯৯০ সালে এটিপি ট্যুর শুরু হওয়ার পর থেকে, এটি বিশ্বব্যাপী পুরুষদের পেশাদার টেনিসের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়ে খেলোয়াড় ও টুর্নামেন্টের কর্মকর্তাদের সমান অংশগ্রহণে খেলার দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, গত পাঁচ বছরে খেলোয়াড়দের আয় $70 মিলিয়ন ডলার বেড়েছে এবং এটি এখন শীর্ষ ২৫০ জন একক খেলোয়াড়ের জন্য একটি সর্বনিম্ন গ্যারান্টিযুক্ত আয়ের ব্যবস্থা করে।
ডব্লিউটিএও একই সুরে তাদের অবস্থান রক্ষা করার কথা জানিয়েছে।
তারা পিটিপিএ-এর এই পদক্ষেপকে “দুর্ভাগ্যজনক এবং ভুল” হিসেবে অভিহিত করেছে।
সংস্থাটি জানায়, ডব্লিউটিএ খেলোয়াড়েরা টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমান সদস্য হিসেবে ডব্লিউটিএ-র পরিচালনায় একটি অপরিহার্য এবং প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর রাখে।
আইটিআইএ সিএনএনকে জানিয়েছে, তারা মামলার বিষয়ে অবগত আছে, তবে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়।
আইটিএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নেবে।
সংস্থাটি আরও জানায়, তারা একটি অলাভজনক সংস্থা এবং খেলার বিশ্বব্যাপী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে টেনিসকে একটি বৈশ্বিক ক্রীড়া হিসেবে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে।
আয়ের ৯০% তারা খেলার বৈশ্বিক উন্নয়নে পুনর্বিনিয়োগ করে থাকে।
পিটিপিএ তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মামলার কিছু বিষয় তুলে ধরেছে।
তাদের দাবি, শীর্ষ ২৫০ জনের বেশি পুরুষ ও মহিলা খেলোয়াড়, এমনকি শীর্ষ ২০ জনের বেশিরভাগ খেলোয়াড় এই আইনি পদক্ষেপের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
পিটিপিএ আরও অভিযোগ করেছে, খেলোয়াড়দের প্রতি সংস্থাগুলোর ‘উদাসীনতার’ কারণে তাঁদেরকে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায় খেলতে হয়, এমনকি ম্যাচ শেষ হয় ভোর ৩টায়।
এছাড়া ইনজুরি-সৃষ্টিকারী টেনিস বল ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়।
তাদের মতে, ১১ মাসব্যাপী খেলার মৌসুম খেলোয়াড়দের পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয় না।
সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে খেলোয়াড়দের অভিযোগ, তারা পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ সীমিত রাখতে, নতুন প্রতিযোগী ও টুর্নামেন্টকে বাজারে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং খেলোয়াড়দের নাম, ছবি ও পরিচিতি ব্যবহারের (NIL) অধিকার থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয় না।
পিটিপিএ-এর দাবি, অন্যান্য খেলার তুলনায় টেনিস খেলোয়াড়েরা আয়ের মাত্র ১৭% পান, যেখানে অন্য খেলাগুলোতে খেলোয়াড়েরা ৩৫%-৫০% পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।
ভ্যাসেক পসপিসিল এক বিবৃতিতে বলেন, “এটা শুধু অর্থের বিষয় নয় – এটি ন্যায্যতা, নিরাপত্তা এবং মৌলিক মানবিক মর্যাদার বিষয়।
আমি ভাগ্যবান খেলোয়াড়দের একজন, কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতে ম্যাচের জন্য ভ্রমণ করার সময় আমাকে গাড়িতে ঘুমাতে হয়েছে।
কোনো আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়কে যদি বলা হয়, তিনি প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে গাড়িতে ঘুমাবেন, তবে বিষয়টি কেমন হবে?
এটা হাস্যকর এবং কখনোই ঘটবে না।
অন্য কোনো প্রধান খেলা তার খেলোয়াড়দের সঙ্গে এমন আচরণ করে না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আমাদের অন্যায় চুক্তিতে বাধ্য করে, অমানবিক সময়সূচী চাপিয়ে দেয় এবং আমাদের মুখ খুলতে দেয় না।”
বাদীরা চাইছে আদালত যেন প্রমাণ পান যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো শেরমান আইনের (anti-monopoly laws) লঙ্ঘন করেছে।
সেইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেয় আদালত।
মামলাটিতে সংস্থাগুলোকে তাদের অর্জিত মুনাফা ত্যাগ করতে এবং খেলোয়াড়দের জন্য একটি ট্রাস্ট তহবিল তৈরি করারও আবেদন জানানো হয়েছে, যেখান থেকে খেলোয়াড়েরা ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন