ফিলিস্তিনি ফুটবল দল: যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মাঝে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দল ঘোষণা
ফুটবল খেলার উন্মাদনা বিশ্বজুড়ে, আর তার রেশ শুধু মাঠের খেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দলের খেলোয়াড় নির্বাচন থেকে শুরু করে সমর্থকদের মধ্যে উদ্দীপনা জাগানো—সবকিছুই এখন আধুনিক ফুটবল জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সম্প্রতি, আসন্ন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জন্য ফিলিস্তিনি ফুটবল ফেডারেশন (পিএফএ) যে দল ঘোষণা করেছে, তা এক ভিন্ন আবেদন সৃষ্টি করেছে। জর্ডান এবং ইরাকের বিরুদ্ধে খেলার জন্য নির্বাচিত এই দলের ঘোষণা যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মাঝে ধারণ করা একটি ভিডিওর মাধ্যমে করা হয়েছে।
গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে, যেখানে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে সবকিছু বিপর্যস্ত, সেখানেই এই ভিডিওর দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি শিশুরা তাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছে—ধ্বংসস্তূপের মাঝে, সমুদ্রের ধারে পাথরের ওপর, বাজারের আনাচে-কানাচে এমনকি একটি তাঁবুর ক্লাসরুমেও।
ডিফেন্ডার মুসাব বাতাতের ছবি পাওয়া যাচ্ছে সমুদ্রের পাথরের ওপর, ফরোয়ার্ড ওদেয় দাব্বাগকে দেখা যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, আর সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার মিলাদ টারমানিনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে একটি অস্থায়ী জল বিতরণ কেন্দ্রের পাশে।
ভিডিওতে একদিকে শিশুদের হাসিখুশি ছবি, যারা খেলোয়াড়দের ছবি সংগ্রহ করে একটি মরিচা ধরা গোলপোস্টের সঙ্গে টাঙাচ্ছে, অন্যদিকে রয়েছে যুদ্ধের বিভীষিকা। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৮,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১,২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল এবং ২৫০ জনের বেশি অপহৃত হয়েছিল।
ফিলিস্তিনি ফুটবল ফেডারেশন (পিএফএ) সূত্রে জানা গেছে, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪০৮ জন ফুটবলার নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এবং অধিকাংশই শিশু।
পিএফএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট সুজান শালাবি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, ভিডিওটি তৈরি করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এটি করা জরুরি ছিল। তিনি বলেন, “আমি বলতে পারি, এটা খুবই বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু এটা করা দরকার ছিল।
যদি এই দল গাজার কোনো শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তাহলে সেটি সার্থক হবে। ভিডিওর শিশুরা এটি করতে চেয়েছিল, কারণ তাদের এখনো আশা আছে। তাদের জন্যই এটা করা।
সুজান শালাবি আরও জানান, গাজায় পিএফএ-এর অফিস হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, না হয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে সেগুলোকে ঘর হারানো পরিবারের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ফুটবল বিশ্বে দল ঘোষণার এমন দৃষ্টান্ত নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের আগে ইংল্যান্ড তাদের খেলোয়াড়দের নাম চায়ের কাপ, শার্ট এবং পোস্টারে লিখে একটি আবেগপূর্ণ ভিডিও প্রকাশ করেছিল, যা খেলার প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল।
ফিলিস্তিনি দলের এই ভিডিও শুধু খেলোয়াড়দের নাম জানানোর চেয়েও বেশি কিছু। সুজান শালাবি বলেন, “গাজায় আমাদের জনগণের ওপর যে গণহত্যা চলছে, তা আমাদের সবাইকে কষ্ট দেয়।
আমরা এমন একটি পরিস্থিতির শিকার, যা আমাদের জাতি হিসেবে মুছে ফেলতে চাইছে। তবুও, আমরা ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে উঠি, এই ভূমিতে গভীরভাবে প্রোথিত এবং অস্বীকার করা যায় না যে আমরা জীবিত।
ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ৭৫ শতাংশ সদস্য রাষ্ট্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে তারা এখনো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পূর্ণ সদস্যপদ পায়নি। তবে, ফিফা (FIFA) ১৯৯৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনকে ফুটবল দলের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফিলিস্তিন দল গত তিনটি এশিয়ান কাপ টুর্নামেন্টে খেলেছে, তবে এখনো বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
ফিলিস্তিনি দলের এই ভিডিও শুধু একটি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে না, বরং এর চেয়েও বেশি কিছু বোঝাতে চায়। শালাবির মতে, এই ভিডিওর মূল বার্তা হলো ফিলিস্তিনি জনগণের টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছা।
তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে গাজায় যা ঘটছে, তা আমাদের সবাইকে তাড়া করে ফেরে। আমাদের জাতি হিসেবে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও, আমরা ঘুরে দাঁড়াই।
তথ্য সূত্র: সিএনএন