শিরোনাম: গাজায় নতুন করে সামরিক অভিযান, নেতানিয়ামের ‘পূর্ণ বিজয়ের’ ঘোষণা।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী বিতর্কিত নেতাজিম করিডোর পুনর্দখলের জন্য একটি সীমিত স্থল অভিযান শুরু করেছে। এই করিডোরটি গাজাকে বিভক্ত করেছে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই পদক্ষেপ গাজায় নতুন করে আক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর আগে ব্যাপক বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ৪৪০ জন নিহত হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত কয়েকদিনের হামলায় মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড বিভাগের প্রধান জাহের আল-ওয়াহিদি এই হামলাগুলোকে যুদ্ধের শুরু থেকে গাজায় হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ দিন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেইর আল-বালাহ অঞ্চলে জাতিসংঘের দুটি গেস্ট হাউসে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একজন জাতিসংঘ কর্মী নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই ঘটনার তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেছেন, “সংঘাতের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোর কাছে জাতিসংঘের সব স্থাপনার অবস্থান জানা আছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, তাদের রক্ষা করতে এবং তাদের অখণ্ডতা বজায় রাখতে তারা বাধ্য।
তবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জাতিসংঘের ভবনটিতে আঘাত হানার কথা অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, জাতিসংঘের কম্পাউন্ডের আশেপাশে তাদের কোনো অভিযান চলেনি এবং তারা সেখানে কোনো আঘাতও করেনি।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর এই নতুন অভিযান হামাসের সঙ্গে দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা গাজার উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বলেছে, যাতে তারা কোনো লড়াইয়ের মধ্যে আটকা না পড়ে।
পশ্চিমী সাহায্য সংস্থাগুলোর মতে, নেতাজিম করিডোরে আগে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা গভীর রাতে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। এরপর বুধবার ভোরে সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকসহ ইসরায়েলি সেনারা সেখানে প্রবেশ করে।
ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে চারটি সুরক্ষিত ঘাঁটি পুনর্দখল করেছে এবং সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে উত্তর থেকে দক্ষিণে গাজায় যাওয়া সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে “পূর্ণ বিজয়” অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে বন্দী থাকা ৫৯ জন জিম্মিকে মুক্ত না করা পর্যন্ত এই নতুন অভিযান চলবে। জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল নেতাজিম করিডোর থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজার সাধারণ মানুষকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি এক ভিডিও বার্তায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শ অনুসরণ করে ইসরায়েলি জিম্মিদের ফিরিয়ে দিতে এবং হামাসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের আহ্বান জানিয়েছেন।
গ্যালান্ট বলেন, “জিম্মিদের ফিরিয়ে দিন এবং হামাসকে সরিয়ে দিন, তাহলে আপনাদের জন্য বিশ্বের অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগসহ অন্যান্য বিকল্প খোলা হবে।
যুদ্ধবিরতির সময় ইসরায়েলি বাহিনী গাজার চারপাশে একটি বাফার জোনে ফিরে গিয়েছিল। যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরবাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।
গত ১৭ দিন আগে যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর, ইসরায়েল গাজার উপর অবরোধ পুনর্বহাল করে, যার ফলে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান পুনরায় শুরু হওয়ায় গত ৩৬ ঘণ্টায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা কর্মীদের পরিস্থিতি সামাল দিতে সমস্যা হচ্ছে। আইসিআরসি এক বিবৃতিতে জানায়, “গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসা সামগ্রীর মজুদ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
এর উপর, হাসপাতালের কর্মীরা হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য একে অপরের উপর দোষ চাপিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
এছাড়াও, প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৯,০০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, হামাস যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ ৩০ থেকে ৬০ দিন বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরেই গাজায় নতুন করে হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
হামাস জানিয়েছে, তারা স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান চায়।
অন্যদিকে, ইসরায়েল দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করতে রাজি নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে গাজা থেকে সব ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং গাজায় বন্দী থাকা জিম্মিদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।
হামাস কর্মকর্তা তাহের আল-নুনু বুধবার বলেছেন, “হামাস আলোচনার দরজা বন্ধ করেনি, তবে আমরা জোর দিচ্ছি যে নতুন করে কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই।
নুনু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য “জরুরি পদক্ষেপ” নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে “স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের” অভিযোগ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল এই অচলাবস্থা ভাঙার জন্য নতুন করে হামলা শুরু করেছে। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইতিহাসের অধ্যাপক ড্যানি ওরবাখ বলেছেন, “যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে ইসরায়েলের প্রবল আপত্তি ছিল।
এর অর্থ হতো হামাস গাজায় ক্ষমতায় থাকত এবং ইসরায়েলকে অবরোধও তুলে নিতে হতো। দুই পক্ষের স্বার্থের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ বিভেদ ছিল।
ইসরায়েলের সমালোচকরা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ বাজেট ভোটের আগে তার জোট সরকারকে শক্তিশালী করতে, যুদ্ধবিরতির পক্ষে জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের সমর্থনে জনমত গড়তে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষের মোকাবিলা করার জন্য নতুন করে অভিযান শুরুর অভিযোগ করেছেন।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গভীর বিভেদ দেখা যাচ্ছে। নতুন করে এই অভিযান শুরুর প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার ইসরায়েলের হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। আগামী দিনগুলোতে আরও বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান