যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি’র (JFK) ১৯৬৩ সালের হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত গোপন নথিগুলো অবশেষে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে প্রকাশিত দুই হাজারের বেশি নথিতে, কেনেডি হত্যা রহস্য নিয়ে চলা ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর ওপর নতুন করে আলোকপাত করা হয়েছে।
তবে, নথিগুলো থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি যা সরকারি তদন্তের ফলাফলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর, টেক্সাসের ডালাস শহরে এক জনসমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয় লি হার্ভে অswaldকে।
ঘটনার দুই দিন পরেই, এক নাইটক্লাবের মালিক জ্যাক রুবি’র গুলিতে নিহত হন ওসওয়াল্ড। কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন, যা ওয়ারেন কমিশন নামে পরিচিত।
১৯৬৪ সালে, এই কমিশন তাদের তদন্ত শেষে জানায়, ওসওয়াল্ড একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন এবং এতে অন্য কারো জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, কেনেডি’র মৃত্যুর পর থেকেই অনেকেই এই সরকারি ভাষ্যকে বিশ্বাস করতে চাননি। ২০২৩ সালের একটি জনমত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৬৫ শতাংশ আমেরিকান ওয়ারেন কমিশনের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত নথিগুলোও সেই ধারণার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ যোগ করতে পারেনি। ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার প্রেসিডেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক মার্ক সেলভারস্টোন এক সাক্ষাৎকারে জানান, “আমার মনে হয় না, ওসওয়াল্ড যে একাই কেনেডিকে হত্যা করেছিল, সেই ধারণার বিপরীতে যাওয়ার মতো কোনো তথ্য এই নথিতে আছে।
প্রকাশিত নথিতে জানা যায়, কেনেডিকে হত্যার আগে ওসওয়াল্ড মেক্সিকো সিটিতে সোভিয়েত ও কিউবান দূতাবাসে গিয়েছিলেন। একটি নথিতে ওসওয়াল্ডের সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটানো সময়ের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৫৯ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান এবং ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। নথিতে কেজিবি’র একজন এজেন্ট নিকোনভের নাম পাওয়া যায়, যিনি ওসওয়াল্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের এজেন্ট ছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখেছিলেন।
এছাড়াও, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওসওয়াল্ডের ওপর নজর রাখত। নব্বইয়ের দশকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসওয়াল্ড সম্ভবত ভালো নিশানাবাজ ছিলেন না।
নথিগুলোতে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং পররাষ্ট্র নীতির কিছু দিক উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘অপারেশন ম্যাঙ্গুজ’ নামে পরিচিত একটি গোপন অভিযানের কথা জানা যায়, যার উদ্দেশ্য ছিল কিউবার কমিউনিস্ট সরকারকে অস্থিতিশীল করা।
এছাড়াও, সিআইএ’র পক্ষ থেকে ১৫০০ জন এজেন্টকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল, যাদের মধ্যে ১২৮ জন ছিলেন প্যারিসের মার্কিন দূতাবাসে।
কেনেডি’র একজন সহযোগী, আর্থার স্লেইসিঞ্জার জুনিয়র, এই ধরনের কার্যক্রমের সমালোচনা করে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
নথিগুলোতে অন্যান্য দেশের সরকার উৎখাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৯ সালে কিউবার ক্ষমতা দখল করা ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাত করার জন্য ১৯৬৩ সালে সিআইএ’র কর্মকর্তাদের মধ্যে হওয়া কথোপকথনের বিবরণ পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ডেভিড ব্যারেট জানান, “আমরা দেখছি কিউবার কাস্ত্রোসহ অন্যান্য দেশের নেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্রের অনেক তথ্য।
প্রকাশিত নথিগুলোর মধ্যে একটি সিআইএ মেমোতে ডমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ট্রুজিলোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ‘ই৪ডিইইডি’ নামে পরিচিত গোপন কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্য ছিল। ট্রুজিলোকে ১৯৬১ সালের মে মাসে হত্যা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আর্কাইভস-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯২ সালের ‘জেএফকে রেকর্ডস অ্যাক্ট’-এর অধীনে প্রায় ৩ লক্ষ ২০ হাজার নথির মধ্যে ৯৯ শতাংশই ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে বলেছিলেন, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব নথি প্রকাশ করবেন। কিন্তু, সিআইএ এবং এফবিআই-এর আপত্তির কারণে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার নথি পর্যালোচনা করার পর তিনি প্রায় ২,৮০০ নথি প্রকাশ করেন।
এরপর, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন আরও ১৭ হাজার নথি প্রকাশ করে। বর্তমানে, প্রায় ৪,৭০০ নথি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হয়েছে।
প্রকাশিত নথিতে কেনেডি হত্যার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করেন, ওসওয়াল্ড হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, আবার কারো কারো ধারণা ছিল, সিআইএ’র যোগসাজশ ছিল।
তবে, নথিতে এমন কোনো তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কেনেডি হত্যার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। কেউ বলেন, একাধিক ব্যক্তি মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, আবার কারো মতে, বিদেশি কোনো শক্তি এর পেছনে ছিল।
কেউ কেউ আবার তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জনসনকে ক্ষমতা দখলের জন্য দায়ী করেন। এমনকি, ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্পও তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজের বাবার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নথি প্রকাশ স্বচ্ছতা আনতে সহায়তা করবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা