বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে, পারস্য বর্ষবরণের উৎসব ‘নওরোজ’ উদযাপন করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, বরং নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এক উজ্জ্বল প্রতীক।
ইরান, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, বলকান অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশসহ বিভিন্ন স্থানে এই উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পরে। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য।
নওরোজ, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ ‘নতুন দিন’, এই উৎসবটি মূলত বসন্তের প্রথম দিন এবং পারস্য সৌর ক্যালেন্ডারের নববর্ষের সূচনা করে। ঐতিহ্য অনুসারে, এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে, যা প্রাচীন পারস্যের জরাথুস্ট্রবাদ থেকে এসেছে।
এটি বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা আজও অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রাচীন উৎসব হারিয়ে গেলেও, নওরোজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।
নওরোজ উদযাপনের সঠিক সময়টি নির্ধারিত হয় জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব অনুযায়ী, যখন সূর্য তার কক্ষপথে পৃথিবীর বিষুবরেখা অতিক্রম করে। এই ঘটনাটি কেবল উত্তর গোলার্ধে বসন্তের সূচনা করে না, বরং দিন ও রাতের মধ্যে একটি প্রায় সমান অবস্থা তৈরি করে, যা নওরোজের মূল ধারণা – নতুন শুরু, ভারসাম্য এবং পরিবর্তনের প্রতীক।
২০২৫ সালে, এই বিশেষ মুহূর্তটি ঘটবে ২০শে মার্চ, বৃহস্পতিবার, দুপুর ১২টা ৩১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে (ইরান স্ট্যান্ডার্ড সময়), যা বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী সকাল ৯টা ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
ঐতিহ্যগতভাবে, নওরোজ পারস্য সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত অঞ্চলগুলোতে পালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ইরান, আফগানিস্তান, আজারবাইজান, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো (যেমন উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান) এবং ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য ও বলকান অঞ্চলের কিছু অংশ।
এছাড়াও, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দি সম্প্রদায়, সেইসঙ্গে ভারতের পার্সি ও জরাথুস্ট্রীয় সম্প্রদায়ও এই উৎসব পালন করে থাকে।
নওরোজ উদযাপনের মূল ভাবনা হলো নতুন করে শুরু করা, শুদ্ধিকরণ এবং সম্পর্কের উদযাপন। বিভিন্ন দেশে এই উৎসব পালনের ধরন ভিন্ন হতে পারে, তবে কিছু মূল রীতি-নীতি সবার মধ্যে দেখা যায়।
উৎসবের আগে, পরিবারগুলো তাদের ঘর পরিষ্কার করে, যা খারাপ শক্তি দূর করে নতুন একটি শুরুর প্রতীক। উৎসবের আগের বুধবারে সন্ধ্যায়, মানুষজন অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে জড়ো হয়ে তাতে লাফ দেয়, যা অতীতের দুঃখ-কষ্ট ভুলে নতুন উদ্যমে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক।
নওরোজের প্রথম কয়েক দিন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া, উপহার বিনিময় এবং বিশেষ খাবার খাওয়ার মধ্যে কাটে। এই সময় নতুন পোশাক পরা হয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেমন – সবজি পোলো বা মাছি (সবজি ও মাছ দিয়ে তৈরি ভাত) ও আশ-ই-রেশতেহ (নूडলস স্যুপ) পরিবেশন করা হয়।
উৎসবের ১৩তম দিনে পরিবারগুলো বাইরে বনভোজনে যায়, যেখানে তারা খোলা বাতাসে আনন্দ করে এবং খারাপ ভাগ্যকে বিদায় জানায়।
নওরোজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘হাফত সিন’ টেবিল (Haft Sin Table)। এই টেবিলে ফার্সি ‘স’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া সাতটি বিশেষ জিনিস সাজানো হয়, যেগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব প্রতীকী অর্থ রয়েছে।
এই প্রথাটির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় এটি প্রাচীন পারস্য থেকে এসেছে। প্রাচীনকালে মানুষ বিশ্বাস করত যে, কিছু প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন – গাছপালা, ফল এবং মশলার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও সুরক্ষামূলক ক্ষমতা রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই জিনিসগুলো হাফত সিনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে এবং সাত সংখ্যাটি পারসিক ও জরাথুস্ট্রীয় বিশ্বাসে গভীর তাৎপর্য বহন করে। এটি সৃষ্টি, ভারসাম্য এবং জীবনের মৌলিক উপাদান (আকাশ, পৃথিবী, জল, গাছপালা, প্রাণী, আগুন এবং মানুষ)-এর প্রতীক।
হাফত সিন টেবিলে থাকা প্রতিটি জিনিসের বিশেষ অর্থ রয়েছে:
- সবজেহ (Sabzeh): নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে গমের চারা বা ঘাস।
- সামানু (Samanu): ধৈর্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মিষ্টি পুডিং।
- সির (Sir): স্বাস্থ্য ও আরোগ্যের প্রতীক হিসেবে রসুন।
- সেব (Seb): সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আপেল।
- সেনজেদ (Senjed): ভালোবাসা ও আবেগের প্রতীক হিসেবে শুকনো ফল।
- সিরকেহ (Serkeh): বয়স ও ধৈর্যের প্রতীক হিসেবে ভিনেগার।
- সোমান (Somaq): সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রতীক হিসেবে একটি বিশেষ মসলা।
এই সাতটি জিনিসের সঙ্গে, টেবিলে প্রায়ই একটি আয়না রাখা হয়, যা গত বছরের প্রতিফলন ঘটায়। এর সঙ্গে থাকে নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে রঙিন ডিম, নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে সোনার মাছ এবং আলো ও সুখের প্রতীক হিসেবে মোমবাতি।
কিছু পরিবার তাদের টেবিলে কোরআন, শাহনামা (ফার্সি মহাকাব্য), অথবা হাফেজের কবিতা যুক্ত করে, যা নতুন বছরে জ্ঞান ও আশীর্বাদ নিয়ে আসে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা