হ্যারী হুডিনি: এক কিংবদন্তীর জীবন ও মৃত্যু
হ্যারী হুডিনি, যিনি অসম্ভব থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষমতার জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত, তাঁর আসল নাম ছিল এরিক ভাইজ। ১৮৭৪ সালে বুদাপেস্টে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছিলেন একাধারে জাদুকর এবং দুঃসাহসিক কার্যকলাপের শিল্পী। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা এক ইহুদি অভিবাসী হয়েও তিনি কিভাবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই গল্প আজও মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়।
ছোটবেলায় এরিক এবং তাঁর পরিবার হাঙ্গেরি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। সেখানে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটলেও, শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল কিছু করে দেখানোর অদম্য ইচ্ছা। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি হাতের কৌশল রপ্ত করতে শুরু করেন এবং সাত বছর বয়সে সার্কাসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। বাবার অসুস্থতার কারণে পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হলে, তিনি খেলা দেখানোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেন।
যুবক বয়সে, তিনি ফরাসি জাদুকর জ্যাঁ ইউজিন রবার্ট-হুডিনের আত্মজীবনী পাঠ করে মুগ্ধ হন। তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এরিক নিজের নামের শেষে ‘ই’ যোগ করে ‘হুডিনি’ রাখেন। পরবর্তীতে তিনি ‘হ্যারী’ নামটি গ্রহণ করেন এবং তাঁর ভাই থিওডোর হার্ডিনকে সঙ্গে নিয়ে সার্কাস দল গঠন করেন। এই দলে ছিল উচ্চাঙ্গের কলাকৌশল প্রদর্শন, সাপ খেলা এবং নর্তকীর নাচ।
তাঁদের খ্যাতি আসে ‘মেটামরফসিস’ নামক একটি অভিনব খেলার মাধ্যমে, যা ১৮৯৩ সালের শিকাগো বিশ্ব মেলায় প্রথম পরিবেশিত হয়। এই খেলায় থিওডোর হ্যারীকে একটি থলের মধ্যে বেঁধে একটি বাক্সে ভরে ফেলতেন, মুহূর্তের মধ্যে হ্যারীর বদলে থিওডোর এসে হাজির হতেন, যা দর্শকদের বিস্মিত করত। এরপর তিনি বিয়ে করেন উইলহেলমিনা বিট্রিস রাহনারকে, যিনি পরবর্তীতে বেস হুডিনি নামে পরিচিত হন এবং আজীবন তাঁর মঞ্চ সহযোগী ছিলেন।
হুডিনির আসল খ্যাতি আসে হাতকড়া থেকে মুক্তি পাওয়ার কৌশল দিয়ে। তিনি বিভিন্ন শহরে গিয়ে সেখানকার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাতকড়া পরার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তা খুলে ফেলতেন। সংবাদমাধ্যমে তাঁর এই কীর্তি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা তাঁর শোয়ের প্রচারের জন্য দারুণ সহায়ক ছিল।
তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বিভিন্ন দেশে অভিনয়ের সুযোগ পান। ১৯০০ সালে তিনি ব্রিটেনে এবং ১৯০৩ সালে রাশিয়ায় পারফর্ম করেন। রাশিয়ায় তিনি এতটাই খ্যাতি লাভ করেন যে জার-এর নিরাপত্তা কর্মীরাও তাঁর কৌশল দেখে হতবাক হয়েছিলেন।
হুডিনির খ্যাতি বাড়ার সাথে সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীও বাড়ে। অনেকে তাঁর কৌশল নকল করতে শুরু করে, ফলে তিনি তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করতে আরও বেশি ঝুঁকি নিতে শুরু করেন। একবার তিনি জার-এর কারাগারে বন্দী হয়ে মাত্র ৪৫ মিনিটে মুক্তিলাভ করেন। এরপর তিনি জলের ট্যাঙ্ক থেকে মুক্তি, শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় জলে ঝাঁপ দেওয়া এবং বাক্সবন্দী হয়ে সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সব খেলা দেখিয়েছেন।
হুডিনির জীবন ছিল একদিকে যেমন সাফল্যের, তেমনই অন্যদিকে ছিল রহস্যে ঘেরা। ১৯০৮ সাল থেকে তিনি একটি জলের ট্যাঙ্কে বন্দী হয়ে মুক্তি পাওয়ার কৌশল প্রদর্শন করতেন। ১৯১২ সালে তিনি এই কৌশলে আরও পরিবর্তন আনেন, যেখানে তাঁকে উল্টো করে লোহার খাঁচায় বন্দী করে রাখা হতো। দর্শকদের মধ্যে তাঁর এই দুঃসাহসিক কার্যকলাপ ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
১৯১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য গ্রিম গেম’ নামক চলচ্চিত্রে হুডিনি অভিনয় করেন, যেখানে তিনি একজন পালানোর ওস্তাদের চরিত্রে ছিলেন। তাঁর এই সিনেমা দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হুডিনির জীবনের শেষ অধ্যায় ছিল বেশ নাটকীয়। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে, মন্ট্রিয়লে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। সেখানে এক ছাত্র তাঁর পেটের শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং তাঁর উপর ঘুষি চালানোর অনুমতি চায়। হুডিনি রাজি হলে, সেই ছাত্রটি তাঁর পেটে সজোরে ঘুষি মারে। এই আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। কয়েক দিন পর, ১৯২৬ সালের ৩১শে অক্টোবর, ৫২ বছর বয়সে ডেট্রয়েটে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয় পেরিটোনাইটিস, যা অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণে হয়েছিল।
তবে, হুডিনির মৃত্যুর কারণ নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ছাত্রদের ঘুষিটিই তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর জিনিসপত্র ভাই থিওডোরকে দিয়ে যান এবং তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।
হুডিনিকে নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। অভিনেতা ও পরিচালক অরসন ওয়েলস একবার বলেছিলেন যে, হুডিনি নাকি রাশিয়ার জার-এর সঙ্গে দেখা করার সময় শুধু হাত নেড়ে মস্কোর ক্রেমলিনের ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। যদিও এই গল্পটি বেশ অবিশ্বাস্য, তবে এটি হুডিনির জাদুকরী ক্ষমতার প্রতি মানুষের ধারণাকে আরও জোরালো করে।
হ্যারী হুডিনি ছিলেন যুক্তিবাদী একজন মানুষ, যিনি সবসময়ই বাস্তবতার ওপর জোর দিতেন। কিন্তু তাঁর জীবন এবং মৃত্যু আজও মানুষের মনে এক ধরনের রহস্যের সৃষ্টি করে। তাঁর সাহস, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং প্রতিকূলতা জয় করার মানসিকতা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক