গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, যা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি কয়েক দিনের হামলায় কমপক্ষে ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গাজার হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা চলছে, এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মরদেহ উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে।
মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই নতুন ইসরায়েলি অভিযানে নারী ও শিশুদের হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, হামলার সময় অনেকে ঘুমিয়ে ছিলেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মঙ্গলবার চালানো প্রথম দফা বিমান হামলায় দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায় এবং এতেই ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ১৮৩ জন শিশু ও ৯৪ জন নারী ছিলেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে সর্বশেষ হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, নতুন এই বিমান অভিযানের লক্ষ্য ছিল হামাসের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদাভ শশানি বুধবার জানান, হামাসের সামরিক ও সরকারি সক্ষমতা দুর্বল করতে এবং ইসরায়েলের প্রতি হুমকি কমাতে গাজায় ‘কয়েক ডজন সন্ত্রাসী আস্তানা ও সন্ত্রাসীদের’ ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের খবরে প্রকাশ, বৃহস্পতিবার খান ইউনিসের কাছে আবাসন আল-কাবিরা গ্রামে একটি পরিবারে হামলা চালানো হয়, যেখানে নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
স্থানীয় ইউরোপিয়ান হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হামলায় নিহত ১৬ জনের মধ্যে এক বাবা ও তাঁর সাত সন্তান ছিল। এছাড়া, এক মাস বয়সী এক শিশুর বাবা-মা ও ভাইও নিহত হয়।
শিশুটির তার দাদা-দাদির সঙ্গে প্রাণে বেঁচে যায়।
ইসরায়েল গাজার উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ফিলিস্তিনিদের এলাকা ছাড়ার জন্য নতুন করে সতর্কবার্তা দিয়েছে, যাতে তারা কোনো সংঘর্ষের শিকার না হয়।
একইসঙ্গে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেৎজারিম করিডোরটি তারা পুনরায় দখল করেছে, যা গাজার কেন্দ্র দিয়ে বিস্তৃত এবং ভূখণ্ডটিকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করেছে।
জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে, ইসরায়েল এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা আলোচনার পর এই করিডোর থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
সেখানে তারা বিদ্যমান প্রায় সব ভবন ভেঙে ফেলে রাস্তা প্রশস্ত করে এবং সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।
নতুন করে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের কারণে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে স্থল হামলার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও বর্তমানে তারা বিমান হামলার ওপর বেশি নির্ভরশীল।
ইসরায়েল ও হামাস একে অপরের ওপর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
হামাস জানিয়েছে, তারা মিশরের মধ্যস্থতায় হওয়া তিন-পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাস্তবায়ন চায়।
হামাস এখনো গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে চালানো হামলায় বন্দী করা প্রায় ২৫০ জনের মধ্যে ৫৯ জনকে তাদের কাছে রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এদের অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে মারা গেছে।
বৃহস্পতিবার হামাস জানায়, ইসরায়েলি অভিযান বন্ধ করতে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। হামাস আবারও ইসরায়েলকে আগের চুক্তিতে সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস তিন-পর্যায়ের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ ৩০-৬০ দিনের জন্য বাড়াতে রাজি না হওয়ায় গাজায় হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
হামলার আগে তারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।
তবে ইসরায়েলের এই নতুন অভিযানের সামরিক জবাব এখনো দেয়নি হামাস।
তবে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টায় ইয়েমেন-ভিত্তিক হুতি মিলিশিয়াদের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সতর্কতামূলক সাইরেন ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে শোনা যায়।
ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আকস্মিক হামলায় বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিকসহ প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়েছিল।
এর জবাবে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায়ও প্রায় ৪৯,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েলের সমালোচকরা বলছেন, নেতানিয়াহু পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ বাজেট ভোটের আগে তাঁর জোট সরকারকে শক্তিশালী করতে এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে যুদ্ধবিরতির পক্ষে জনমত দুর্বল করতে নতুন করে এই অভিযান শুরু করেছেন।
একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানকে বরখাস্ত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে দৃষ্টি সরানোরও চেষ্টা করছেন তিনি।
ইসরায়েলের গভীর বিভাজন আবারও স্পষ্ট হয়েছে, যখন বুধবার হাজার হাজার মানুষ নতুন করে এই অভিযানের বিরুদ্ধে এবং নেতানিয়াহু সরকারের নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে।
বৃহস্পতিবার আরও বিক্ষোভের পরিকল্পনা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান