ট্রেন দে আরাগুয়া গ্যাং: যুক্তরাষ্ট্রের ‘আক্রমণ’ নিয়ে ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য।
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতি আরও কঠোর করতে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার একটি অপরাধী চক্র, ট্রেন দে আরাগুয়াকে (Tren de Aragua) দায়ী করে দেশটির উপর ‘আক্রমণ’-এর অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ বর্তমানে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ট্রাম্পের এই যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ এবং অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, একটি গ্যাংয়ের উপস্থিতি বা অবৈধ অভিবাসন কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর ‘আক্রমণ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
ট্রাম্পের দাবি, ট্রেন দে আরাগুয়া নামক এই গ্যাং যুক্তরাষ্ট্রের উপর ‘আক্রমণ’ চালিয়েছে। এই যুক্তির স্বপক্ষে তিনি একটি হোয়াইট হাউজ ঘোষণার উদ্ধৃতি দেন, যেখানে বলা হয়, “ট্রেন দে আরাগুয়া যুক্তরাষ্ট্রের উপর আক্রমণ ও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।”
এই ঘোষণার মাধ্যমে, যারা এই গ্যাংয়ের সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাননি, তাদের গ্রেপ্তার ও বিতাড়িত করার জন্য ১৯১৮ সালের ‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ (Alien Enemies Act) ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসনকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি বিতর্কিত এই আইনটি প্রয়োগ করতে চাইছেন।
তবে, এই আইন প্রয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য কোনো দেশ কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণা বা আক্রমণের প্রমাণ থাকতে হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উপর কোনো বিদেশি শক্তি বা গ্যাংয়ের আক্রমণ হয়নি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অভিবাসন বা একটি অপরাধী চক্রের উপস্থিতিকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। যদিও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, গ্যাং সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করা যেতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে অভিবাসন আদালতের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
‘এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ সেই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে, কোনো ‘শত্রু রাষ্ট্র’ বা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ অথবা তাদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হলে, শুনানির সুযোগ ছাড়াই অভিযুক্তদের আটক ও বিতাড়িত করা যায়।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রেন দে আরাগুয়ার উপস্থিতি প্রমাণ করতে দুটি পরস্পরবিরোধী যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথমত, ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার কিছু অঞ্চলে ট্রেন দে আরাগুয়া একটি আধা-সরকারের মতো কাজ করছে, যেখানে ভেনেজুয়েলা সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গ্যাংটি সরাসরি মাদুরো সরকারের সঙ্গে জড়িত এবং সরকারের ছত্রছায়ায় কাজ করছে। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এক বিবৃতিতে জানান, ভেনেজুয়েলা সরকারই ট্রেন দে আরাগুয়াকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক নোয়া ফেল্ডম্যানের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন একইসঙ্গে দাবি করছে যে গ্যাংটি ভেনেজুয়েলার সরকার এবং সরকারের থেকে স্বাধীন। ভেনেজুয়েলাসহ অন্যান্য দেশগুলো তাদের কারাগার খালি করে অপরাধীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে বলেও ট্রাম্প বেশ কয়েকবার মন্তব্য করেছেন, যদিও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ভেনেজুয়েলার অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোনা রিসকুয়েজ, যিনি ট্রেন দে আরাগুয়া নিয়ে একটি বই লিখেছেন, জানিয়েছেন, এই গ্যাং ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে একটি কারাগারে কার্যক্রম চালাত।
তবে, গ্যাংটি ভেনেজুয়েলা সরকারের নির্দেশে কাজ করে বা তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এমন কোনো প্রমাণ তিনি দেখেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, ‘আক্রমণ’ শব্দটির ব্যবহার জাতীয় নিরাপত্তা, যুদ্ধ বিষয়ক ক্ষমতা এবং রাজ্যগুলোর যুদ্ধ ঘোষণার সীমিত অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে, সংবিধানে ‘আক্রমণ’-এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।
অতীতেও আদালত অভিবাসনকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করতে রাজি হয়নি। তাঁদের মতে, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতির বিষয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘আক্রমণ’ শব্দটির মূল অর্থ হলো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান।
অতীতে এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ব্যবহারের তিনটি ঘটনা ছিল—১৮১২ সালের যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই তিনটি সময়ই ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি।
তবে, ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত কংগ্রেসকে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য অনুরোধ করেননি, যেমনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট করেছিলেন। এমনকি, এমন কোনো সশস্ত্র হামলারও তিনি উল্লেখ করেননি, যা এই আইনের প্রয়োগের কারণ হতে পারে।
বর্তমানে, টেক্সাস অঙ্গরাজ্যও অভিবাসনকে কেন্দ্র করে নিজেদের ‘আক্রমণের শিকার’ দাবি করে একটি আইন পাস করেছে। তবে, আদালত এই বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা