শিকাগোর এক ঝলমলে জীবন থেকে ভ্যালেন্সিয়ার শান্তিতে: শোককে জয় করে নতুন দিগন্তের সূচনা।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে স্বামী এবং ছেলেকে নিয়ে মারিয়া রবার্টসন-জাস্টিসিয়ানোর জীবনটা ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে তার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়, যখন আকস্মিকভাবে তার স্বামী অ্যালেক্স মারা যান।
প্রিয়জনের এই আকস্মিক প্রয়াণে মারিয়ার জীবনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। তিনি জানান, এই ঘটনার পর শিকাগোতে থাকাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
মারিয়া জানান, তিনি সবসময়ই ভ্যালেন্সিয়াকে নিজের দ্বিতীয় ঘর হিসেবে মনে করতেন। যদিও তিনি যুক্তরাজ্যে জন্ম গ্রহণ করেন এবং কানাডায় বেড়ে ওঠেন, কিন্তু মাঝেমধ্যে স্প্যানিশ শহরটিতে সময় কাটাতেন।
মাঝবয়সে কিছুদিনের জন্য সেখানে বসবাসও করেছিলেন তিনি। এরপর, স্বামীর মৃত্যুর চার বছর পর, ছেলেকে নিয়ে তিনি স্পেনের ভ্যালেন্সিয়াতে পাড়ি জমান, যেখানে তার মায়ের জন্ম হয়েছিল।
তখন তার ছেলে লুকাসের বয়স ছিল ১৪ বছর।
ভ্যালেন্সিয়া আমাদের নিরাময় করতে সাহায্য করেছে।
শিকাগোতে থাকাকালীন মারিয়ার কর্মজীবন বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি যেন জীবনের মোড় খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
মারিয়ার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এক ঝড়ের কবলে পড়েছেন। শোকের সেই সময়ে তিনি তার প্রিয়জনদের হারানোর কষ্ট অনুভব করছিলেন।
তিনি তাদের ছেড়ে যেতে চাননি, কিন্তু এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
২০২১ সালে, স্পেন ভ্রমণে গিয়ে মারিয়ার ছেলে লুকাস তাদের ভ্যালেন্সিয়াতে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা জানায়। এরপর মারিয়া সেখানকার জীবন শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
তিনি তার বাড়ি বিক্রি করেন, আসবাবপত্র বিক্রি করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্পেন যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
ভ্যালেন্সিয়ায় স্থানান্তরিত হওয়াটা তার জন্য খুব সহজ ছিল না। প্রথমে তিনি সেখানে একটি বাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি পাওয়া যায়নি।
এমনকি তিনি গোল্ডেন ভিসাও পাননি, যা অ-ইউরোপীয় নাগরিকদের স্পেনে বসবাসের অনুমতি দেয়। অবশেষে, তিনি স্প্যানিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন, যা ছিল বেশ কঠিন একটা প্রক্রিয়া।
তবে তিনি যেহেতু স্প্যানিশ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন, তাই তার সুবিধা হয়েছিল। অবশেষে, সেই বছরই তিনি নাগরিকত্ব পান।
ভ্যালেন্সিয়াতে আসার পর মারিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি বলেন, “মনে হচ্ছিল যেন আমি কাঙ্ক্ষিত ভূমিতে পৌঁছেছি… এটা ছিল অসাধারণ অনুভূতি।
মনে হচ্ছিল যেন আমি ম্যারাথন দৌড় শেষ করেছি।”
গত তিন বছরে, মারিয়া এবং লুকাস স্প্যানিশ সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মারিয়া মনে করেন, এখানকার পরিবেশে থাকার কারণে তাদের দু’জনেরই মানসিক শান্তি ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, “আমি এখন অনেক শান্ত একজন মানুষ।”
মারিয়া জানান, তিনি তার অতীতের আঘাত থেকে সেরে ওঠার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, “অ্যালেক্সের মৃত্যুর পর, আমি আয়রনম্যান (একটি দীর্ঘ দূরত্বের দৌড়) করার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম… আমি আমার মাথা ঠিক রাখতে পারছিলাম না।
আমি শুধু যা ঘটেছে সেদিকে মনোযোগ দিতে চাচ্ছিলাম না।”
তিনি আরও বলেন, “আঘাতের কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে থাকার কারণে আমি যেন সবকিছু নতুন করে দেখতে শুরু করি।”
মারিয়া ও তার ছেলে তাদের বন্ধুদের খুব মিস করেন, তবে তারা এখন ভ্যালেন্সিয়ায় অনেক খুশি। মারিয়া বলেন, “লুকাস এখানে থাকতে রাজি হওয়ায় সবকিছু সহজ হয়েছে।
যদি সে রাজি না হতো, তাহলে আমার জন্য পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হতো।”
মারিয়ার মতে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকার চেয়ে লুকাস স্পেনে বেশি নিরাপদ। তিনি বলেন, “আমি এখন তাকে স্কুলে পাঠানো নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, যা আমেরিকান স্কুলগামী শিশুদের জন্য একটা বড় উদ্বেগের বিষয়।
এখানে মানুষের কাছে বন্দুক নেই। এটি ছিল আমার জন্য একটি বড় স্বস্তি।”
মারিয়া মনে করেন, ভ্যালেন্সিয়া আমেরিকানদের তুলনায় বেশ সাশ্রয়ী, তবে এখানকার জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
বিশেষ করে বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের জন্য এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভ্যালেন্সিয়ায় বর্তমানে অনেক মানুষের আগমন ঘটছে। মারিয়া জানান, ২০ বছর আগেও তিনি যখন এখানে আসতেন, তখন রাস্তায় আমেরিকানদের খুব একটা দেখা যেত না।
এখন সেখানে অনেক আমেরিকান অভিবাসী রয়েছে এবং তাদের একটি বড় কমিউনিটি তৈরি হয়েছে।
মারিয়া চান, তিনি এবং লুকাস যেন ভ্যালেন্সিয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন। ভবিষ্যতে কী হবে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।
তবে তিনি তার পুরনো জীবনকে মাঝে মাঝে মিস করেন।
মারিয়া মনে করেন, পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে নতুন চোখে সবকিছু দেখার সুযোগ হয়। তিনি বলেন, “পরিবেশ পরিবর্তন করলে এবং সবকিছুকে গ্রহণ করতে পারলে, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখা যায়।”
বর্তমানে মারিয়া একটি ওয়েলনেস রিট্রিট কোম্পানি চালান, যার নাম ‘বাই দ্য সি রিট্রিটস’। এছাড়াও তিনি ভ্যালেন্সিয়ায় বসবাস করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য একটি পুনর্বাসন কোম্পানিও শুরু করেছেন, যার নাম ‘ভ্যালেন্সিয়া ভাইবস রিলোকেশন’।
মারিয়া যারা স্পেনে যেতে চান, তাদের ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি সেখানকার আবহাওয়া এবং জীবনযাত্রার ভিন্নতা সম্পর্কেও ধারণা রাখতে বলেন।
তিনি বলেন, “স্পেনের সব জায়গা সবসময় রৌদ্রোজ্জ্বল থাকে না। উত্তর স্পেনে বৃষ্টি হয় এবং ঠান্ডা থাকে।”
মারিয়ার মতে, নতুন একটি দেশে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
যদিও ভ্যালেন্সিয়ায় আসার পথ মসৃণ ছিল না, তবুও তিনি মনে করেন, এটি তার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত ছিল।
অন্য একটি দেশে যাওয়া খুবই আনন্দদায়ক। আমি আমার স্বামীকে হারানোর পর যেন নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। আপনি যখন অন্য একটি দেশে যান এবং একটি ভিন্ন ভাষা শিখেন, তখন আপনি নতুন একজন মানুষ হতে পারেন।
আপনি অন্য একটি জীবন চেষ্টা করতে পারেন। আর এটি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, কারণ আপনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।”
মারিয়ার জীবন হয়তো তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন, তেমনটা হয়নি। তবে তিনি ভবিষ্যতের জন্য খুবই আগ্রহী এবং মনে করেন, তিনি এখন সঠিক স্থানে আছেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন