মহাকাশে নক্ষত্রের বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা থেকে নির্গত হওয়া শক্তিশালী তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর বুকে জীবজগতের জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই ধরনের সুপারনোভা বিস্ফোরণের কারণে সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে দুটি বড় ধরনের ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, গত ১ বিলিয়ন বছরে সূর্যের কাছাকাছি এলাকায় অন্তত ২.৫টি সুপারনোভা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে। এর থেকে ধারণা করা যায়, গত ৫০০ মিলিয়ন বছরে, যখন পৃথিবীতে জীবনের বিকাশ ঘটেছিল, তখন হয়তো এক বা একাধিক সুপারনোভা ঘটেছিল। যুক্তরাজ্যের কীল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক এবং আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ফেলো, নিক রাইট এবং তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করেছেন।
তাঁদের মতে, সুপারনোভা এবং পৃথিবীর জীবজগতের বিলুপ্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। সুপারনোভা আসলে কী? এটি হলো নক্ষত্রের চূড়ান্ত পরিণতি, যখন তারা বিস্ফোরিত হয় এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি ও তেজস্ক্রিয়তা নির্গত করে।
এই বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী হয় যে, এটি আশেপাশের গ্রহ এবং সেখানকার জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সুপারনোভাগুলি সম্ভবত দুটি প্রধান ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল: একটি হলো প্রায় ৩৭২ মিলিয়ন বছর আগের “লেট ডেভোনিয়ান বিলুপ্তি” এবং অন্যটি ৪৪৫ মিলিয়ন বছর আগের “লেট অর্ডোভিসিয়ান বিলুপ্তি”।
এই দুটি ঘটনাতেই পৃথিবীর বুকে বহু প্রজাতির জীব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গবেষকরা বলছেন, সুপারনোভাগুলি সম্ভবত পৃথিবীর ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।
এর ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে এবং ব্যাপক হারে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। তবে, এই গবেষণা এখনো একটি অনুমানের পর্যায়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সুপারনোভা এবং বিলুপ্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রমাণ করতে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।
উদাহরণস্বরূপ, বিলুপ্তির সময়কালে সুপারনোভা থেকে নির্গত কিছু বিশেষ উপাদান, যেমন – আয়রন-৬০ বা প্লুটোনিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে হবে। এই গবেষণার প্রধান লেখক, স্পেনের অ্যালিকান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালেক্সিস কুইন্টানা বলেছেন, “সুপারনোভা বিস্ফোরণগুলি আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিবেশে ভারী রাসায়নিক উপাদান সরবরাহ করে, যা নতুন তারা এবং গ্রহ তৈরি করতে কাজে লাগে।
কিন্তু কোনো গ্রহ, যেমন আমাদের পৃথিবী, যদি এই ধরনের ঘটনার খুব কাছাকাছি থাকে, তবে তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। তবে, বিজ্ঞানীরা এও মনে করেন যে, ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পেছনে শুধুমাত্র সুপারনোভাই দায়ী ছিল না।
এর পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন – বিশাল আকারের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা গ্রহাণুর আঘাত। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে, একটি বিশাল আকারের গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের (University of Bristol) মেরুদণ্ডী জীবাশ্মবিদ্যার অধ্যাপক মাইক বেনটন বলেন, “সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে যে বিলুপ্তি ঘটেছিল, তা প্রমাণ করতে হলে, ঘটনার সময়কালের সঙ্গে মিল খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের সেই সময়ের সুপারনোভা বিস্ফোরণের তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Leeds) প্যালিওএনভায়রনমেন্টের অধ্যাপক পল উইগনাল মনে করেন, এই গবেষণাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর মতে, সুপারনোভা এবং বিলুপ্তির ধারণা নতুন নয়, তবে এর স্বপক্ষে আরও সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রয়োজন। এই গবেষণাটি ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের জটিলতা এবং মহাজাগতিক ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন