সাগরের গভীরে ডুব দিতে পারে সিল মাছ! শ্বাস নেওয়ার কৌশল জানলে অবাক হবেন

গভীর সমুদ্রের প্রাণী সিল (Seal) কীভাবে এতক্ষণ ধরে শ্বাস ধরে রাখতে পারে? সম্প্রতি স্কটল্যান্ডে চালানো এক অত্যাশ্চর্য গবেষণায় এর রহস্য উন্মোচন হয়েছে।

‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় জানা গেছে, সিল তাদের রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ডুব দেওয়ার সময় পরিবর্তন করে।

আমরা মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করি। আমাদের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে, শরীরে জমা হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) পরিমাণ বেড়ে যায়, যা আমাদের শ্বাস নিতে উৎসাহিত করে।

কিন্তু সিল মাছের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। তারা সম্ভবত সরাসরি রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা অনুভব করতে পারে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্ববিদ এবং এই গবেষণার প্রধান লেখক ক্রিস ম্যাকনাইট বলেন, “সিল অক্সিজেনের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, সম্ভবত এ কারণেই তারা পানিতে ডুবে যায় না।”

মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যারা অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই ডুব দেন (ফ্রি-ডাইভার), তাদের প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর কারণ হলো, তারা কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) ওপর বেশি নির্ভরশীল।

কিন্তু সিল মাছ অক্সিজেন দ্বারা প্রভাবিত হয়।

গবেষকরা প্রথমে অল্পবয়সী কিছু ধূসর সিলকে একটি বিশেষ সুইমিং পুলে রাখেন, যা তাদের বন্য পরিবেশে ফেরত পাঠানোর আগে তৈরি করা হয়েছিল।

এরপর তারা একটি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার চেম্বার তৈরি করেন, যেখানে সিলগুলো বৃষ্টি ও বাতাস থেকে আশ্রয় নিতে পারতো। ম্যাকনাইট জানান, “খুব দ্রুতই তারা পুলের পরিবর্তে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য চেম্বারটি বেছে নেয়।”

চেম্বারের চারপাশে এমন ব্যবস্থা ছিল, যাতে তারা পানির উপরিভাগে সাঁতার কাটতে না পারে। তবে পানির নিচে প্রায় ২০০ ফুট সাঁতার কাটলে তারা খাবার পেতে পারতো। তারা ইচ্ছামতো সেখানে মাছ খেতে পারতো।

সিলগুলো যখন এই পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেল, তখন গবেষকরা ধীরে ধীরে চেম্বারের বাতাসের উপাদান পরিবর্তন করতে শুরু করেন।

তারা অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো বা কমানোর মাধ্যমে তাদের ওপর এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন। ম্যাকনাইট বলেন, “আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে, তাদের আচরণের ওপর প্রভাব ফেলার মতো পরিবর্তনগুলো এনেছিলাম।”

পরীক্ষার ফল ছিল বেশ চমকপ্রদ: অক্সিজেনের মাত্রা বেশি থাকলে সিলগুলো ডুব দিয়ে বেশি সময় ধরে খাবার খাচ্ছিল।

ম্যাকনাইট আরও যোগ করেন, “এই পরীক্ষা থেকে আমরা বুঝতে পারি, সিল মাছ কেবল তাদের হৃদস্পন্দন বা শ্বাস-প্রশ্বাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অক্সিজেনের মাত্রার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখায় না, বরং তারা এটিকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম।”

আগে করা কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কম অক্সিজেনের পরিবেশে প্রাণীরা অস্থির হয়ে ওঠে।

কিন্তু সিলদের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। এমনকি তারা তাদের ডুবের সময়ও অক্সিজেনের মাত্রা বিবেচনা করে।

এই বিশেষ ক্ষমতা সিলদের অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে আলাদা করে।

কারণ, ভূমিতে অক্সিজেনের মাত্রা সাধারণত স্থিতিশীল থাকে। তাই মানুষসহ অন্যান্য স্থলচর প্রাণীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে তা অনুভব করার মতো ক্ষমতা তৈরি হয়নি।

ফলে, ডুব দেওয়ার সময় কার্বন ডাই অক্সাইডের ওপর নির্ভর করাটা মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

ম্যাকনাইট ব্যাখ্যা করেন, “ডাঙায় কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হওয়া শ্বাসকষ্টের ইঙ্গিত দেয়, তাই এটি একটি স্বাভাবিক কৌশল। কিন্তু ডুব দেওয়ার সময়, বিশেষ করে বারবার ডুব দিলে, এটি বিপজ্জনক হতে পারে।

প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময়, আমরা আমাদের কার্বন ডাই অক্সাইড সংবেদনশীলতা পুনরায় সেট করি, এমনকি যদি এর মাত্রা বেশিও থাকে।” এর ফলে, ডুবুরিরা পানির নিচে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডুবুরি শরীরতত্ত্ববিদ পিটার লিন্ডহোম এই গবেষণা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, “আমি মনে করি, মানুষের ক্ষেত্রেও এই ধরনের পরীক্ষা করা উচিত, যেখানে দেখা হবে, কোনো ব্যক্তি অক্সিজেনের মাত্রা অনুভব করতে পারে কিনা অথবা কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রতি তাদের সহনশীলতা কেমন।”

ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী শরীরতত্ত্ববিদ আন্দ্রেয়াস ফাহলম্যান মনে করেন, “সমুদ্রের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এর প্রতি সংবেদনশীলতা কম থাকে, যা সম্ভবত তাদের অক্সিজেনের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে।”

তবে, কিছু গবেষক এই গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানী উইলিয়াম মিলসোম বলেন, “পরীক্ষার তথ্য এই গবেষণার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে, তবে এটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নয়।”

তিনি আরও যোগ করেন, “সিল যে শ্বাস নেওয়া অক্সিজেনের পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের ডুবের আচরণ পরিবর্তন করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, আরও বিস্তারিত শারীরবৃত্তীয় তথ্য ছাড়া, কম অক্সিজেনের কারণে তাদের ডুবের সময় কেন কমে যায়, তা স্পষ্টভাবে বলা কঠিন।”

ওটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্ববিদ ম্যাথিউ পামেন্টার মনে করেন, অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উভয়ই ডুবের সময়কে প্রভাবিত করে।

তিনি আরও বলেন, “এই গবেষণায় প্রস্তাবিত ক্ষমতাটি সম্ভবত অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান সংবেদনশীলতার একটি উন্নত সংস্করণ।”

ম্যাকনাইট মনে করেন, সিলগুলো কেবল খুব কম অক্সিজেনের স্তরের প্রতিক্রিয়া জানায় না, বরং তারা অক্সিজেনের একটি বিস্তৃত পরিসীমা বিবেচনা করে।

সবশেষে, ম্যাকনাইট বলেন, “অন্যান্য ডুবুরি প্রাণীদের মধ্যেও সম্ভবত এই ধরনের ক্ষমতা বিদ্যমান।

হাঁস, কচ্ছপ এবং কুমিরের ওপর করা আগের কিছু পরীক্ষাও সিলদের আচরণের অনুরূপ।”

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *