ইউরোপীয় ফুটবলে জুয়াড়ি কোম্পানিগুলোর ব্যাপক আর্থিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এই গবেষণা অনুযায়ী, ইউরোপের ৩১টি শীর্ষ লিগের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দলের সঙ্গেই কোনো না কোনো জুয়া খেলার সংস্থার স্পন্সরশিপ চুক্তি রয়েছে।
বর্তমানে, ২০২৩-২৪ মৌসুম শেষ হওয়ার পরেই, ২০২৬-২৭ মৌসুম থেকে প্রিমিয়ার লিগে জার্সি-র সামনে জুয়াড়ি সংস্থাগুলোর লোগো ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আসতে চলেছে। যদিও এই ধরনের বিধিনিষেধ এড়াতে ইউরোপের ক্লাবগুলো নানা কৌশল অবলম্বন করছে।
খবর অনুযায়ী, অনেক ক্লাব জুয়াড়ি সংস্থাগুলোর দাতব্য সংস্থা অথবা তাদের নিউজ বা বিনোদনমূলক ওয়েবসাইটগুলোর লোগো ব্যবহার করছে।
অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা সংস্থা ‘ইনভেস্টিগেট ইউরোপ’ এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্যের শীর্ষ লিগগুলোর ৪৪২টি দলের মধ্যে ২৯৬টিরই জুয়া বিষয়ক কোনো না কোনো সংস্থার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে ১৪৫টি দলের জার্সির সামনে জুয়া খেলার স্পন্সরদের লোগো দেখা যায়।
ইতালির ক্লাবগুলো তাদের জার্সির সামনের দিকে জুয়া কোম্পানিগুলোর পরিবর্তে তাদের দাতব্য সংস্থা অথবা নিউজ/বিনোদন ওয়েবসাইটের লোগো ব্যবহার করছে।
এছাড়াও, ৩১টি লিগের মধ্যে ১৪টির প্রধান স্পন্সর একটি জুয়া কোম্পানি। ইউরোপের শীর্ষ ৫টি লিগের ২৭টি ক্লাবের সঙ্গে এশিয়া-ভিত্তিক জুয়া কোম্পানিগুলোর অংশীদারিত্ব রয়েছে।
প্রিমিয়ার লিগে জুয়া বিষয়ক বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি বেশ পরিচিত একটি বিষয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১১টি দলের খেলোয়াড়দের জার্সির সামনে জুয়া খেলার লোগো রয়েছে, যা ইউরোপের শীর্ষ ৫টি লিগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
‘গ্লোবাল ডেটা’ নামক একটি গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, জুয়া কোম্পানিগুলো এই মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর জার্সিতে স্পন্সর করার জন্য প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪৮৫ কোটি টাকা) খরচ করেছে।
তবে, অন্যান্য লিগগুলোও এই তালিকায় পিছিয়ে নেই।
নেদারল্যান্ডসের ‘এরেডিভিসি’ লিগের প্রতিটি দলেরই জুয়া খেলার কোনো না কোনো স্পন্সর রয়েছে। পর্তুগাল, গ্রিস এবং জার্মানির বাজারও এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এমনকি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ার শীর্ষ লিগগুলোতেও জুয়া খেলার লোগোযুক্ত জার্সি দেখা যায়।
কিছু দেশে জুয়া খেলার স্পন্সরশিপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও, ক্লাবগুলো বিভিন্ন উপায়ে সেই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাচ্ছে।
যেমন, বেলজিয়ামে জার্সি স্পন্সরশিপের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হাতার উপর লোগো ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।
কিন্তু, অনেক ক্লাব তাদের জার্সির সামনে জুয়া কোম্পানির নামের অংশবিশেষ ব্যবহার করছে।
ক্লাব ব্রুজ (Club Brugge) তাদের জার্সির স্পন্সর হিসেবে ‘ইউনিবেট’ (Unibet)-এর পরিবর্তে ‘ইউ-এক্সপার্টস’ (U-Experts) -কে বেছে নিয়েছে, যা আসলে ‘ইউনিবেট’-এর তৈরি একটি নিউজ অ্যাপ, যার মাধ্যমে ক্যাসিনোতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।
ইতালিতে ২০১৮ সাল থেকে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
সেখানেও, ২০২১-২২ মৌসুমে সিরি-আ-এর তিনটি ক্লাবের জার্সিতে জুয়া খেলার স্পন্সর দেখা গেছে।
ক্লাবগুলো হল ইন্টার মিলান (Betsson.sport), পার্মা (AdmiralBet.news) এবং লেচ্চে (BetItalyPay)। মিলান ক্লাব বোমার্যাং বেট (Boomerang Bet) নামে একটি জুয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে, যদিও সেই কোম্পানির ইতালিতে ব্যবসা করার কোনো লাইসেন্স ছিল না।
অন্যদিকে, অনেক ক্লাব এমন সব কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে, যাদের জাতীয় পর্যায়ে ব্যবসা করার অনুমতি নেই।
এছাড়া, এশিয়া-ভিত্তিক অনেক জুয়া কোম্পানিরও ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব রয়েছে, যাদের ইউরোপে সরাসরি ব্যবসা করার অনুমতি নেই।
শীর্ষ ৫টি লিগের ২৭টি ক্লাবের সঙ্গে এশিয়া-ভিত্তিক ২২টি জুয়া কোম্পানির চুক্তি রয়েছে। ইতালির ৮টি ক্লাবের সঙ্গে এশিয়া-ভিত্তিক জুয়া কোম্পানিগুলোর চুক্তি রয়েছে, যা শুধুমাত্র এশিয়া থেকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেই দেখা যায়।
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের গবেষকদের মতে, প্রিমিয়ার লিগের একটি খেলার প্রথম দিনেই প্রায় ৩০,০০০ জুয়া খেলার বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬৫% বেশি।
এমনকি, এইসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে জার্সি স্পন্সরশিপের অবদান ছিল ১০%-এর কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) জুয়া ও জুয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য চার্লস লিভিংস্টোন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, জুয়া খেলার বিজ্ঞাপনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হলে জুয়া খেলার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
“জুয়া কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে, কারণ এর মাধ্যমে তারা নতুন জুয়াড়িদের আকৃষ্ট করতে পারে।
সবচেয়ে বেশি লাভ হয় তাদের, যারা জুয়া খেলতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। তাই, জুয়া কোম্পানিগুলোকে নিয়মিতভাবে নতুন জুয়াড়ি সংগ্রহ করতে হয়।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান