মার্কিন মুলুকে আটকের শিকার, ট্রাম্পের প্রতিহিংসা? জর্জেটাউন স্কলারকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর রায়!

যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত হামাস-এর প্রচার চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের দেশত্যাগে আপাতত বাধা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (আজ) ভার্জিনিয়ার একটি আদালত এই নির্দেশ দেয়।

ভারতীয় নাগরিক বাদার খান সুরীকে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশে আটক করা হয়েছিল।

আদালতের বিচারক প্যাট্রিসিয়া টলিভার গাইলস এক আদেশে জানান, আদালত অন্য কোনো নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাদার খান সুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা যাবে না।

আদালতে পেশ করা নথিতে সুরীর আইনজীবী জানান, সামাজিক মাধ্যমে করা কিছু পোস্ট এবং তাঁর স্ত্রীর ফিলিস্তিনি পরিচয় ও তাঁর সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত মত প্রকাশের কারণে সুরীকে নিশানা করা হয়েছে।

সুরীর আইনজীবী হাসান আহমেদ আরও জানান, বাদার খান একজন শিক্ষাবিদ, কোনো কর্মী নন। তিনি ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি, তাঁর স্ত্রী ইসরায়েলি সরকারের কঠোর সমালোচক এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো সহিংসতার প্রতিবাদকারী।

আইনজীবীর দাবি, ফেডারেল কর্তৃপক্ষ সুরীর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের প্রমাণ দিতে পারেনি। তাঁর এই আটক, বাকস্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার লঙ্ঘনের শামিল। সুরীর কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই এবং তিনি একজন পরিদর্শক স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার ভিসা পান। তাঁর স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।

আদালতে আরও বলা হয়, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল নীতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণকারীদের শাস্তি দেবে।

হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী সচিব ট্রিয়া মেকলাফলিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন, সুরীর বিরুদ্ধে হামাসের প্রচার এবং ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এর পরেই তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

খবর অনুযায়ী, সোমবার রাতে ভার্জিনিয়ার বাড়ি থেকে সুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আইনজীবীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুখোশ পরা এজেন্টরা সুরীর গ্রেপ্তারের কারণ জানায়নি, তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে একটি সাদা নম্বর প্লেটবিহীন কালো এসইউভিতে তুলে নিয়ে যায়।

সুরীর স্ত্রী দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে এর কারণ জানতে চান, কিন্তু এজেন্টরা জানায় তাঁরা হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোক এবং তাঁর ভিসা বাতিল করা হয়েছে, তাই চ্যানটিলি নামক স্থানে তাঁকে আটক রাখা হবে।

সুরীর আইনজীবী আরও জানান, বাদার খান ও তাঁর স্ত্রী মাফিজা সালেহ দীর্ঘদিন ধরে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। একটি ওয়েবসাইটে মিথ্যাভাবে দাবি করা হয়েছে যে তাঁদের হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।

মাফিজা সালেহ আদালতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, তিনি সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং সবসময় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন, এই ভয়ে যে কখন আবার কেউ এসে তাঁকে ও তাঁর সন্তানদের নিয়ে যাবে।

আদালতের নথি অনুযায়ী, মাফিজা সালেহ মিসৌরিতে জন্মগ্রহণ করলেও পাঁচ বছর বয়স থেকে গাজায় ছিলেন। তাঁরা ২০১৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে বিবাহ করেন এবং সেখানেই বসবাস করতেন।

২০২২ সালে বাদার খান যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং পরের বছর তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।

জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলাম বিষয়ক রাজনীতির অধ্যাপক নাদের হাশেমি জানান, বাদার খান তাঁর শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিবেদিত ছিলেন, যা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়া এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে গঠিত ছিল।

অধ্যাপক আরও জানান, বাদার খান ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীর সংহতি ও সহানুভূতি অনুভব করতেন, তবে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে তাঁকে দেখা যায়নি।

আলওয়ালিদ সেন্টার ফর মুসলিম-ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর পরিচালক হাশেমি বলেন, ৭ অক্টোবরের (ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর দিন) পর থেকে তাঁরা ডজনখানেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, কিন্তু বাদার খানকে কোনোটিতে দেখা যায়নি।

তিনি এমন মানুষ ছিলেন না। বাদার খান ও তাঁর স্ত্রী-কে আগে থেকেই ডানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী নিশানা করছিল, যার কারণ ছিল মাফিজা সালেহর বাবা, যিনি এক সময় হামাসের উপদেষ্টা ছিলেন।

নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আহমেদ ইউসুফ নিশ্চিত করেছেন যে বাদার খান তাঁর জামাতা।

তিনি আরও বলেন, বাদার কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন না, এমনকি হামাসের পক্ষেও নয়। ইউসুফ জানান, তিনি এক দশকেরও বেশি সময় আগে গাজায় হামাস সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং বর্তমানে জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলওয়ালিদ সেন্টার এক বিবৃতিতে জানায়, বাদার খানের গ্রেপ্তার ‘যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা ধ্বংস এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের একটি অভিযান’-এর অংশ।

সরকারের একটি ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, সুরীকে পরে লুইসিয়ানার একটি ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়।

তাঁর আইনজীবীরা দ্রুত মুক্তির আবেদন করেছেন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটি হেবিয়াস কর্পাস মামলা করে দেশত্যাগের প্রক্রিয়া বন্ধের চেষ্টা করছেন।

সুরীর আইনজীবীরা বলছেন, পরিবার ও আইনজীবীর থেকে ১০০০ মাইলের বেশি দূরে তাঁর আটক রাখা প্রতিশোধমূলক এবং তাঁর মতপ্রকাশের শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।

আগে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ বাসিন্দা মাহমুদ খলিল-কে ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে আটক করা হয়েছিল।

তিনি বর্তমানে দেশত্যাগের বিরুদ্ধে আদালতে লড়াই করছেন।

এছাড়াও, কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. রেশা আলাউয়াহকে ভিসা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।

ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য ডন বেয়ার, যাঁর নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্তিতে সুরীকে আটক করা হয়েছে, এক বিবৃতিতে জানান, শিক্ষকের আটক বেআইনি ছিল এবং তিনি আদালতের কাছে সুরীর বিষয়টি বিবেচনার আবেদন জানান।

বেয়ার আরও বলেন, সুরীর অধিকার লঙ্ঘনের ‘যুক্তি’ সংবিধানের আরেকটি লঙ্ঘন: এটি বাকস্বাধীনতার ওপর একটি স্পষ্ট আঘাত।

বাদার খান ও তাঁর পরিবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাকস্বাধীনতার ওপর আক্রমণের শিকার।

সুরীর আইনজীবীরা জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে চান।

জর্জটাউনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তিনি আফগানিস্তান ও ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়ে গবেষণা করে ভারতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সুরীকে ইরাক ও আফগানিস্তানে শান্তি বিনির্মাণ নিয়ে ডক্টরাল গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথভাবে ভিসা দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় আরও জানায়, তারা তাঁদের কমিউনিটির সদস্যদের মুক্ত আলোচনা ও বিতর্কের অধিকারকে সমর্থন করে, এমনকি যদি এর পেছনের ধারণাগুলো কঠিন, বিতর্কিত বা আপত্তিকর হয়।

তাঁরা আশা করেন, আইনি প্রক্রিয়া এই মামলার সুষ্ঠু সমাধান করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্ট-এর ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, বাদার খান বর্তমানে লুইসিয়ানার আলেকজান্দ্রিয়া স্টেজিং ফ্যাসিলিটিতে অভিবাসন কর্মকর্তাদের হেফাজতে রয়েছেন।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *