আউশভিটজের বন্দী নারীদের এক মর্মস্পর্শী সঙ্গীত-যাত্রা: অ্যান সেবার নতুন বই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে, নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষী ছিল আউশভিটজ-এর বন্দী শিবিরগুলো। এখানে বন্দীদের উপর চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন, কেড়ে নেওয়া হতো তাদের জীবন।
কিন্তু এই মৃত্যুপুরীতেও টিকে থাকার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা – আউশভিটজের নারী অর্কেস্ট্রা। সম্প্রতি প্রকাশিত অ্যান সেবার নতুন বই ‘দ্য উইমেন’স অর্কেস্ট্রা অফ আউশভিটজ: এ স্টোরি অফ সারভাইভাল’ সেই নারীদের দুঃসাহসিক জীবন সংগ্রামের এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছে।
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত, আউশভিটজ-বিরকেনাউ বন্দী শিবিরে ৪০ জনের বেশি নারীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এই অর্কেস্ট্রা।
এদের নেতৃত্বে ছিলেন আলমা রোজ, যিনি ছিলেন বিখ্যাত সুরকার গুস্তভ মাহলারের ভাইঝি। রোজ ছিলেন একজন অসাধারণ বেহালাবাদক।
তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বন্দীদের মধ্য থেকে সেরা সঙ্গীতশিল্পীদের খুঁজে বের করেন। এই দলে ছিলেন অপেশাদার থেকে শুরু করে নামকরা শিল্পীও।
তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন সঙ্গীতের ছাত্রী, আবার কারও ছিল সঙ্গীতের সামান্য জ্ঞান।
শিবিরের কঠিন পরিস্থিতিতে, অর্কেস্ট্রার সদস্যদের জীবন ছিল কিছুটা হলেও আলাদা।
তাদের কঠিন শারীরিক শ্রম থেকে মুক্তি দেওয়া হতো। এমনকি অসুস্থ হলে গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর পরিবর্তে চিকিৎসার সুযোগ পেতেন তারা।
সেবার বই অনুযায়ী, আলমা রোজের এই ত্যাগের কারণে প্রায় ৪০ জন বন্দী নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
অর্কেস্ট্রার সদস্যরা প্রতিদিন সকালে যখন বন্দীরা কাজের জন্য যেত, এবং সন্ধ্যায় যখন তারা দুর্বল শরীর নিয়ে ফিরত, তখন তাদের সামরিক মার্চ বাজাতে হতো।
এছাড়াও, তারা ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, তবে ইহুদি সুরকার মেন্ডেলসোন ও মাহলারের কাজগুলো সেখানে নিষিদ্ধ ছিল।
এই অর্কেস্ট্রার সৃষ্টি একদিকে যেমন ছিল বন্দীদের জন্য বেঁচে থাকার একটি উপায়, তেমনই অন্যদিকে এটি ছিল এক গভীর নৈতিক সংকট।
সঙ্গীত পরিবেশনের বিনিময়ে তারা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতেন, যা তাদের জীবন বাঁচিয়েছিল। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা নাৎসিদের সহযোগী হিসেবেও পরিচিত হয়েছিলেন।
বইটিতে ফ্যানিয়া ফেনেলন নামের এক ফরাসি গায়িকা এবং ফ্লোরা জ্যাকবস নামের একজন পিয়ানোবাদকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও, সেখানে আনা হয়েছে আনেটা লাসকার-ওয়ালফিস নামের এক সেলোবাদকের কথা, যিনি বর্তমানে ৯৯ বছর বয়সেও জীবিত আছেন।
তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে কুখ্যাত চিকিৎসক জোসেফ মেনজেলে একদিন তাকে শুমানের ‘ট্রাউমেইরি’ বাজাতে বলেছিলেন।
অর্কেস্ট্রার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা, মনোমালিন্য এবং ইহুদি-বিরোধী মনোভাব দেখা যেত।
তবে এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল তাদের টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছা।
অ্যান সেবার এই বইটি সেই নারীদের সাহস ও আত্মত্যাগের এক অসাধারণ দলিল, যা পাঠকদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান