মেটিস শিশুদের জীবনে নেমে আসা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা!

শিরোনাম: ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার: রুয়ান্ডা থেকে আসা এক নারীর মর্মস্পর্শী কাহিনী

এক সময়, যখন রুয়ান্ডা ছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশ, তখন সেখানকার মেটিস শিশুদের (যাদের মা ছিলেন আফ্রিকান এবং বাবা ছিলেন বেলজিয়ান) জীবন ছিল এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন। তাদের পরিচয় ছিল দ্বন্দ্বে ভরা, ভালোবাসার পরিবর্তে তারা পেয়েছিল বঞ্চনা আর ঘৃণা।

আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই সময়ের এক নারীর কথা, যিনি রুয়ান্ডায় জন্ম নিয়েছিলেন এবং বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছিলেন।

নারীটির শৈশব কেটেছে পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে। তার বাবা মারা যাওয়ার পর বেলজিয়ান কর্তৃপক্ষ তার ভাইদের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে দেয়।

তাদের মায়ের থেকে কেড়ে নেয়া হয় সন্তানদের। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে তারা মেটিস শিশুদের “অবাঞ্ছিত” মনে করত।

এই শিশুদের হয়তো পরিবারের কাছ থেকে দূরে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হতো, না হয় ইউরোপের কোনো পরিবারে দত্তক দেওয়া হতো।

ছোট্ট বয়সে পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এই শিশুদের জীবন কতটা কঠিন ছিল, তা অনুভব করা কঠিন। তাদের অনেকেরই কোনো ঠিকানা ছিল না, ছিল না আপনজন।

তাদের প্রতিপালন করা হত কঠোর নিয়মের মধ্যে, যেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো স্থান ছিল না। তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হতো এক ভিন্ন ধরনের পরিচয়, যা তাদের মানসিক শান্তির পরিবর্তে এনে দিতো এক গভীর ক্ষত।

এই নারীটির জীবনেও ঘটেছিল একই ঘটনা। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে তাকে আলাদা করে দেওয়া হয় এবং পাঠিয়ে দেওয়া হয় বেলজিয়ামে।

সেখানে তিনি এক পালক পরিবারে বড় হন, যেখানে তিনি একাকীত্ব অনুভব করতেন। তার পোশাক ছিল পুরনো, পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও তিনি পেতেন না।

যখন তার বয়স ১১ বছর, তখন তিনি তার পরিচয়পত্র খুঁজে পান, যেখানে তাকে “অবৈধ সন্তান” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই ঘটনা তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

পরবর্তীতে, তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঘেন্ট শহরে যান, যেখানে তিনি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি উপলব্ধি করেন, তার অতীতের সাথে জড়িত অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।

এরপর তিনি তার ভাই ও বোনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।

২০০৭ সালে, তিনি একটি সম্মেলনে যোগ দেন, যেখানে ঔপনিবেশিকতা নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেই আলোচনায় মেটিস শিশুদের কথা তেমনভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

তিনি এর প্রতিবাদ করেন এবং বেলজিয়ান উপনিবেশের ইতিহাস এবং এর ফলস্বরূপ আফ্রিকানদের উপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার দাবি জানান। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি পাওয়ার পর, তিনি মেটিস শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন।

২০০৮ সালে, তিনি ব্রাসেলস, ঘেন্ট এবং অ্যান্টওয়ার্পের মেটিস সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সাথে মিলিত হন। তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন এবং অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

২০১০ সালে, ঘেন্ট উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য ছিল “বেলজিয়ান উপনিবেশের মিশ্র-জাতিগোষ্ঠীর মানুষ”।

এরপর, তারা “উপনিবেশের জারজ সন্তান” নামে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির প্রকাশনার পর প্রদর্শনী ও সংবাদ প্রচার শুরু হয়।

এই কাজটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

এই নারী এবং তার সঙ্গীরা বেলজিয়ামের বিভিন্ন পার্লামেন্টে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। তারা তাদের অতীতের স্বীকৃতি, তাদের ফাইলগুলোতে প্রবেশাধিকার এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার জন্য সহায়তার আবেদন জানান।

সম্প্রতি, বেলজিয়াম সরকার তাদের দুঃখ প্রকাশ করেছে, তবে তাদের এই কষ্টের কি কোনো শেষ আছে?

শিশুদের তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে দেওয়া—এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

মেটিস শিশুদের অনেক মর্মান্তিক গল্প রয়েছে। তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এখনও লড়াই করে যাচ্ছেন।

বর্তমানে, এই নারীরা তাদের অতীতের ইতিহাস সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে গবেষণা তহবিল প্রদানের দাবি জানাচ্ছেন। যদিও তাদের বয়স এখন সত্তরের কোঠায়, তবুও তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান।

এই দুঃসহ অভিজ্ঞতাগুলো তাদের পরিচয়কে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে।

তাদের এই সংগ্রামের গল্প শুনলে আজও গা শিউরে ওঠে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *