পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানের ক্ষত: ফিলিস্তিনিদের দুঃসহ জীবন।
পশ্চিম তীর, ফিলিস্তিন – ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান আর বোমা হামলায় বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনের মানুষ। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ।
আহত, বৃদ্ধ এবং যাদের চলাফেরার ক্ষমতা সীমিত, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েকজন তরুণ ফিলিস্তিনি। তাদের এই ত্যাগ ও সেবার গল্প তুলে ধরা হলো।
গত ২১শে জানুয়ারি, ইসরায়েলি বাহিনী ‘আয়রন ওয়াল’ নামে অভিযান শুরু করার পর থেকেই সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাছে খাবার, পানি ও জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন ওমাইমা ফারাযের মতো কয়েকজন তরুণ।
২৬ বছর বয়সী ওমাইমা জানান, সেনাদের বাধার কারণে হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সেনারা তাদের হুমকি দিত, এলাকা ছাড়তে বলত, এমনকি গুলি করারও ভয় দেখাত।
ওমাইমার চোখে ভাসে এক বৃদ্ধের কথা, যিনি টানা চার দিন ধরে নিজের বাড়িতে আটকা ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, কারণ ইসরায়েলি সেনারা তাদের পথ আটকে দেয়।
অবশেষে, রেড ক্রসের হস্তক্ষেপে তাদের বৃদ্ধের কাছে যাওয়ার অনুমতি মেলে। সেখানে পৌঁছানোর পর তারা দেখেন, লোকটির খাবার ও পানির চরম অভাব। অবশেষে, তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
তুলেকারেম এলাকার আল-আওদা সেন্টারের পরিচালক আলা সুরুজি বলেন, “এই পরিস্থিতির জন্য আমাদের কোনো জরুরি পরিকল্পনা ছিল না।” আল-আওদা সেন্টার এবং বেথলেহেমের আইদা ক্যাম্পের লাজি সেন্টার সেখানকার উদ্বাস্তুদের তালিকা তৈরি করছে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তার ব্যবস্থা করছে।
প্রায় ১৫ জন নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী, যাদের বেশিরভাগই নারী, ইসরায়েলি অভিযানের শুরু থেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা ও ত্রাণ বিতরণের কাজ করছেন। তাদের চোখেমুখে দেখা যায় একটানা কাজ করার ক্লান্তি।
ইসরায়েল কর্তৃক জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-কে সাহায্য করতে বাধা দেওয়ায় স্বেচ্ছাসেবকদের উপর চাপ আরও বেড়েছে।
তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। তারা দিনভর ঘুরে ঘুরে ১১টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া অথবা যেখানে রোগীরা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, সেখানে গিয়ে তাদের সাহায্য করছেন।
তাদের ব্যাগে থাকে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, ग्लूकोজ মনিটর, ব্যান্ডেজ, এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী।
আলা বলেন, “স্থানীয় সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” স্বেচ্ছাসেবকরা মানসিক সমর্থনও দেন, ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সাথে মিলে তারা তাদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেন।
তাদের অনেকেই উদ্বাস্তু এবং ইসরায়েলি বুলডোজার তাদের ঘরবাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।
ওমাইমা ফারাযের ১৮ বছর বয়সী ভাইকে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় হত্যার শিকার হতে হয়েছে। তার শোক এখনো কাটেনি।
তুলেকারেম থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত একটি গ্রাম, কাফর দান। সেখানে শোনা যায় শিশুদের হাসির শব্দ।
সেখানকার একটি বাড়িতে প্রায় ২০ জন শিশুকে একত্রিত করে তাদের ভয় ও রাগ প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। জেনিনের ফ্রিডম থিয়েটার এই কার্যক্রমের আয়োজন করেছে।
ফ্রিডম থিয়েটারের শাতা জারার জানান, “আমরা শিশুদের কাছে থিয়েটার নিয়ে এসেছি।” শিশুরা যাতে তাদের ভেতরের ভয় ও রাগ প্রকাশ করতে পারে, সে জন্য তাদের উৎসাহিত করা হয়।
কাছাকাছি বসে থাকা ৬৭ বছর বয়সী উম মুহাম্মাদ কয়েকজন শিশুকে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, ২০০২ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় জেনিন শরণার্থী শিবিরে তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।
বর্তমানে তিনি একটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি জানি ইসরায়েলি ট্যাংকের ভয়ে কেমন লাগে। তাই আমি চাই, যারা এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সাহায্য করতে।”
আরেকজন মা, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চান না, তিনি বলেন, ইসরায়েলি ড্রোন থেকে তাদের এলাকা খালি করার ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর হেলিকপ্টার থেকে আক্রমণ চালানো হয়।
তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়।
উদ্বাস্তু জীবনের এই কঠিন বাস্তবতায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের ক্ষত সারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা