ফ্লোরিডার সমুদ্রে মাছের মৃত্যু-রহস্য, চিন্তায় বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সমুদ্রগুলোতে মাছের এক অদ্ভুত আচরণ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে। কিছু মাছ এলোমেলোভাবে ঘুরছে এবং অস্বাভাবিকভাবে সাঁতরাচ্ছে, যার ফলে তাদের মৃত্যুও ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে, ফ্লোরিডা কিসের আশেপাশে মাছ এবং রে মাছগুলোকে বৃত্তাকারে ঘুরতে এবং এলোমেলোভাবে সাঁতার কাটতে দেখা গিয়েছিল। এমনকি, বিপন্নপ্রায় ছোট দাঁতযুক্ত করাত মাছ (Smalltooth Sawfish) এলোমেলোভাবে নড়াচড়া করে সমুদ্র তীরে মরে ভেসে উঠেছিল।
এই অস্বাভাবিক ঘটনার শিকার হয়েছিল ৮০টির বেশি প্রজাতির মাছ, যার মধ্যে ছিল স্ন্যাপার, ষাঁড় হাঙ্গর এবং গোলিয়াথ গ্রাউপার। বিজ্ঞানীরা এবং পরিবেশবিদরা এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, বিশেষ করে করাত মাছের ব্যাপক হারে মৃত্যু তাঁদের চিন্তায় ফেলে দেয়।
যদিও ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে, তবে প্রশ্নগুলো থেকেই গিয়েছিল।
এরপর, পানি এবং মাছের নমুনা পরীক্ষার পর গবেষকরা জানতে পারেন, বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষুদ্র শৈবাল (dinoflagellates) থেকে নির্গত একাধিক বিষাক্ত পদার্থের কারণে মাছগুলো মারা যাচ্ছে।
ফ্লোরিডার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম প্রশাসক, থমাস ম্যাথিউজ জানান, “গত বছর, আমরা প্রমাণ পেয়েছিলাম যে ক্ষতিকর শৈবালের আধিক্য মাছগুলো যেখানে ঘুরছিল, সেই স্থানগুলোতে বেশি ছিল।”
বর্তমানে, মাছগুলো আবার ঘুরছে, তবে আগের চেয়ে কম সংখ্যায় এবং সীমিত এলাকা জুড়ে।
ফ্লোরিডার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কমিশন (FWC) সূত্রে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা এখন ভাবছেন, মাছগুলো হয়তো নতুন কোনো উপসর্গের শিকার হচ্ছে, নাকি তারা আগের বছরের বিষক্রিয়ার ফল ভোগ করছে।
ম্যাথিউজ আরও জানান, “আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, পানির শৈবালের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম, যা ২০২৩-২৪ সালের ঘটনার সময় ছিল।”
ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে, FWC-এর কাছে মাছের এই ধরনের আচরণ প্রদর্শনের ৪৪টি খবর এসেছে।
এছাড়া, ডিসেম্বর ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০০টির বেশি এমন ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
নতুন পাওয়া খবরগুলোর মধ্যে ২২টিতে করাত মাছের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৬টির মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে।
ম্যাথিউজ জানিয়েছেন, সম্ভবত আরও একটি করাত মাছের মৃত্যু হয়েছে গত ২০শে মার্চ।
তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আমার থেকে ২০০ গজ দূরে সমুদ্রের তীরে একটি করাত মাছ রয়েছে, যেখান থেকে আমরা এর অবস্থা জানার জন্য রক্ত সংগ্রহ করছি। খুবই দুঃখজনক, কারণ এগুলো অসাধারণ প্রাণী।”
বিষাক্ত পদার্থের উৎস অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
ফ্লোরিডা গাল্ফ কোস্ট ইউনিভার্সিটির গবেষক মাইক পার্সনস নিয়মিতভাবে পানি পরীক্ষা করে সম্ভাব্য বিষাক্ত শৈবালের নমুনা সংগ্রহ করছেন।
এরই মধ্যে গ্যাম্বিয়ারডিসকাস (Gambierdiscus) নামক এক ধরণের শৈবালকে বিষাক্ত পদার্থের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যদিও এর সঠিক প্রজাতি এখনো শনাক্ত করা যায়নি এবং এটি পরিচিত কোনো প্রজাতির সঙ্গেও মেলে না।
গ্যাম্বিয়ারডিসকাস প্রজাতিকে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে বিজ্ঞানীরা এখন বিষাক্ত পদার্থের রাসায়নিক গঠন শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
ম্যাথিউজ বলেন, “পানিতে এটি দেখা যায় না, তাই এটিকে খুঁজে বের করা কঠিন।”
এর মানে হলো, মাছগুলো যখন ঘুরতে থাকে, তখনই নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
গবেষকরা মাছের কানকোতে গ্যাম্বিয়ারডিসকাস শৈবাল খুঁজে পেয়েছেন এবং পানি ও মাছের টিস্যু পরীক্ষায় নিউরোটক্সিনের প্রমাণ মিলেছে।
ম্যাথিউজ আরও যোগ করেন, “আমরা কেবল নিশ্চিত প্রমাণ চাই।”
অজানা গ্যাম্বিয়ারডিসকাস জীবটির বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও, এটি যে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে, তা মাছ (এবং মানুষেরও) স্নায়ু কোষের চারপাশে থাকা মাইলিন আবরণকে আক্রমণ করে।
এর ফলে স্বাভাবিক স্নায়ু সংকেত বাধাগ্রস্ত হয়।
ম্যাথিউজের ভাষায়, “বিষয়টা অনেকটা তারের উপরে থাকা প্লাস্টিকের আবরণের মতো।
যখন সেই আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তারটি কাজ করা বন্ধ করে দেয়।” এই ক্ষতির কারণে মাছের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়, যেমন—ঘুরতে থাকা বা ছটফট করা।
তাহলে, মাছের এই ঘূর্ণন কি নতুন স্বাভাবিক ঘটনা?
শৈবালের এই বৃদ্ধি কেন হচ্ছে, তা বলা কঠিন, এমনটাই মনে করেন বোনফিশ ও টার্পন ট্রাস্টের ফ্লোরিডা কিস ইনিশিয়েটিভের পরিচালক রস বৌসেক।
তিনি মনে করেন, সম্ভবত ২০২৩ সালে এই অঞ্চলে আঘাত হানা একটি তাপপ্রবাহের কারণে এমনটা হয়েছে, যা এই অঞ্চলে অভূতপূর্ব ক্ষতি ডেকে এনেছিল।
তিনি বলেন, “আমাদের কিছু গবেষণা আছে যা এই বিষয়ে আলোকপাত করবে, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পরিবেশের উপর স্থানীয় চাপ এবং তাপপ্রবাহ—এই দুটির ফলেই এমনটা ঘটেছে।”
অতীতেও উচ্চ তাপমাত্রা ক্ষতিকর শৈবালের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
তাপপ্রবাহ যেহেতু আরও ঘন ঘন ঘটছে, তাই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন যে কখন এবং কেন এই শৈবালের প্রজাতিগুলো আবার বাড়তে পারে।
বিজ্ঞানীরা বিষাক্ত শৈবাল এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে, ভালো খবর হলো, এর কারণে মৎস্যশিল্পে কোনো প্রভাব পড়েনি এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এটি এখনো পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
বৌসেক যোগ করেন, “এখনও পর্যন্ত খাদ্য-সংক্রান্ত কোনো ঝুঁকি নেই, যা খুবই স্বস্তিদায়ক।
কারণ, এটি কিসের অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা হতো।”
ম্যাথিউজ জোর দিয়ে বলেন, “জনসাধারণের কাছ থেকে মাছ মারা যাওয়ার খবর পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর মাধ্যমেই আমরা ঘটনাগুলো তদন্ত করতে পারি।”
মাছের এই অস্বাভাবিক আচরণ এলাকার করাত মাছ রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেছে।
বৌসেক বলেন, “ফ্লোরিডায় আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলোর মধ্যে এটি একটি।
বিশাল আকারের এই সামুদ্রিক প্রজাতি, যার মুখে বিশাল করাত রয়েছে, তা আমাদের জন্য কত সৌভাগ্যের! একে আমাদের হারালে চলবে না।
তাই, আমাদের এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।