আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ: ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আমদানি করা ওয়াইন, শ্যাম্পেন এবং অন্যান্য অ্যালকোহলযুক্ত পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইন উৎপাদনের সিংহভাগই হয় এই রাজ্যে।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক ওয়াইন প্রস্তুতকারক মনে করছেন, এটি তাদের ব্যবসার জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে আনবে। একদিকে যেমন কিছু ব্যবসায়ী মনে করছেন, শুল্ক আরোপের ফলে ক্যালিফোর্নিয়ায় উৎপাদিত ওয়াইনের চাহিদা বাড়তে পারে, তেমনই অন্য একটি অংশের আশঙ্কা, এরই মধ্যে বাজারের চাহিদা কমে যাওয়া এবং খরা ও দাবানলের কারণে ফসলের ক্ষতির শিকার হওয়া এই শিল্পের জন্য শুল্ক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জন উইলিয়ামস বলেন, “আমরা একটি কৃষি-পরিবারভিত্তিক ব্যবসা করি, কিন্তু এর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই ধরনের শুল্ক আমাদের শিল্পের জন্য মোটেই ভালো নয়।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় যুক্তরাষ্ট্রর বাজারে তাদের প্রধান রপ্তানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। শুল্ক আরোপ করা হলে ইউরোপীয় ওয়াইন এবং অন্যান্য অ্যালকোহলযুক্ত পণ্যের দাম বাড়বে, যা রেস্টুরেন্ট এবং সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
ট্রাম্পের এই শুল্ক প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর মধ্যে চলমান বাণিজ্য বিরোধের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর আগে ট্রাম্প ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন, যার মধ্যে ইইউ থেকেও আমদানি করা পণ্য ছিল। এর জবাবে ইইউ আমেরিকান হুইস্কির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা আগামী এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
ওয়াইন ব্যবসার সঙ্গে ৪৫ বছর ধরে জড়িত জন উইলিয়ামস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই ধরনের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে ওয়াইন পরিবেশকদের ক্ষতি হবে, যারা প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সরাসরি ওয়াইন কিনে খুচরা বিক্রেতা ও রেস্টুরেন্টগুলোতে সরবরাহ করে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই একই পরিবেশকদের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ব্যবসার ভালো-মন্দ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
উইলিয়ামসের প্রতিষ্ঠান কানাডাতেও ওয়াইন রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কও বর্তমানে বেশ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় কিছু দোকানে আমেরিকান অ্যালকোহল ব্র্যান্ড সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উইলিয়ামস বলেন, “আমরা এখন যত বেশি সম্ভব ওয়াইন বিক্রি করতে চাই। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো ধরনের বাধা আসুক, তা আমরা চাই না।”
ওয়াইনের চাহিদা কি কমছে?
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বয়স্ক ভোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অ্যালকোহল সেবনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় ওয়াইনের চাহিদা কমতির দিকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ওয়াইন ব্যবসার সামগ্রিক বিক্রি ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার একটি পারিবারিক খামার ও আঙুর গাছের নার্সারি পরিচালনাকারী জন ডুয়ার্তে বলেন, “চাহিদা হ্রাসের কারণে ছোট, পারিবারিক মালিকানাধীন ওয়াইনারিগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
ডুয়ার্তের মতে, বড় অ্যালকোহল কোম্পানিগুলো, যারা ওয়াইন আমদানি ও রপ্তানি উভয়ই করে, ইইউ-এর ওয়াইনের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে ছোট ব্যবসার মতো ক্ষতির শিকার হবে না। কারণ, মার্কিন শুল্ক ও সীমান্ত সুরক্ষা বিভাগ (US Customs and Border Protection) আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রদত্ত কিছু শুল্ক, কর ও ফি ফেরত দেয়, যদি কোনো কোম্পানি একই ধরনের পণ্য রপ্তানি করে। ডুয়ার্তে বলেন, শুল্কের কারণে বড় অ্যালকোহল ব্র্যান্ডগুলো বেশি পরিমাণে ইউরোপীয় ওয়াইন আমদানি করতে উৎসাহিত হতে পারে, যাতে তারা রপ্তানির সময় বেশি পরিমাণে রিফান্ড পেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশীয় ওয়াইন শিল্পের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এটা ভালো দিক। তবে বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে ২০০ শতাংশ শুল্ক যোগ করা হলে তা আন্তর্জাতিক ওয়াইন কোম্পানিগুলোর জন্য একটি বিশাল সুবিধা তৈরি করবে, যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ও রপ্তানি করে।”
ডুয়ার্তের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর মধ্যে কিছু বাণিজ্য অবশ্যই ‘অন্যায্য’, তবে এর সমাধান আরও সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।
কিছু ওয়াইন প্রস্তুতকারকের জন্য আশার আলো।
তবে, ক্যালিফোর্নিয়ার সব ওয়াইন প্রস্তুতকারক ট্রাম্পের শুল্ককে ব্যবসার জন্য খারাপ মনে করেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম স্পার্কলিং ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান র্যাক অ্যান্ড রিডেল-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রুস লান্ডকুইস্ট মনে করেন, এই শুল্ক তাদের কোম্পানির পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারে।
২০২৩ সালে ফ্রান্স প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ বোতল শ্যাম্পেন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে, যা এই স্পার্কলিং পানীয়টির রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষ গন্তব্য ছিল। ‘কমিটি শ্যাম্পেন’-এর তথ্য অনুযায়ী, শুল্ক আরোপের ফলে শ্যাম্পেনের দাম বাড়লে তা বাজারের জন্য ‘বিপর্যয়কর’ হবে।
ব্রুস লান্ডকুইস্ট বলেন, “কেউ বাণিজ্য যুদ্ধ চায় না। আমি জানি না, এতে কারও লাভ আছে কিনা। তবে এটা সম্ভবত দেশীয়ভাবে উৎপাদিত স্পার্কলিং ওয়াইনের ব্যবসা বাড়াতে সহায়তা করবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “অধিকাংশ উৎপাদনকারী ছোট আকারের, সাধারণত পারিবারিক মালিকানাধীন, এবং তারা তাদের সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে কর্মসংস্থান দেয়। আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ওয়াইন পণ্যের ওপর পুনরায় মনোযোগ দেওয়াটা অবশ্যই আনন্দের হবে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন