গাজায় শান্তির স্বপ্নভঙ্গ: ইসরায়েলের আক্রমণে কিয়ামত?

গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর আবারও গভীর সংকটে পড়েছে ফিলিস্তিন। ইসরায়েলি বিমান হামলা, ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহে গাজায় কিছুটা শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তা যেন ছিল এক ভয়ংকর ঝড়ের আগের নীরবতা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, গত মঙ্গলবার ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, কামান, ড্রোন এবং নৌবহর একযোগে হামলা চালায়।

এর ফলে প্রায় দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়। এই যুদ্ধবিরতি গাজার ফিলিস্তিনিদের মনে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছিল।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এক ভিডিও বার্তায় গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষকে হামাসকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অন্যথায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধ্বংস ও বিভীষিকা’।

এর দু’দিন পর ইসরায়েলি বাহিনী গাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর দখল করে নেয়। এরপর গ্যালান্ট হামাসকে তাদের হাতে থাকা ৫৯ জন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্টিমেটাম দেন।

তিনি বলেন, জিম্মিদের মুক্তি না দিলে ইসরায়েল গাজার আরও বেশি ভূমি দখল করবে এবং এর জন্য ‘সামরিক ও বেসামরিক সব ধরনের চাপ’ প্রয়োগ করা হবে। এমনকি তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গাজার বাসিন্দাদের স্বেচ্ছায় অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার’ কথাও উল্লেখ করেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য জানুয়ারিতে যে চুক্তি হয়েছিল, ইসরায়েল তা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি।

ইসরায়েলি সরকার ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ নীতি অনুসরণ করছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও দেশটির বামপন্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, যারা নাকি ইসরায়েলি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছে।

ট্রাম্প গাজার পুরো জনসংখ্যাকে স্থানান্তরের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ইসরায়েলের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এখন তা প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন। গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ বানানোর পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

গ্যালান্টের হুমকিগুলোও ট্রাম্পের কথার প্রতিধ্বনি। ট্রাম্পও এর আগে বলেছিলেন, ‘গাজার মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তবে জিম্মিদের মুক্তি না দিলে তাদের মৃত্যু অনিবার্য’।

ইতিহাসবিদরা হয়তো এই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত করবেন। গত বছরের অক্টোবরে হামাসের অপ্রত্যাশিত হামলায় ১,২০০ জন নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।

এরপর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় প্রায় ২৯,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের কারণে খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির ফলে কিছুদিনের জন্য শান্তি ফিরে এলেও, এখন মনে হচ্ছে এটি ছিল নতুন এক ধ্বংসাত্মক অধ্যায়ের শুরু। গ্যালান্ট, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর হুমকিগুলো তারই ইঙ্গিত দেয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আইয়্যাল জামির নেতানিয়াহুকে বলেছেন, হামাসকে ধ্বংস করতে এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে হলে গাজায় ব্যাপক সেনা অভিযান চালাতে হবে।

কিছু ইসরায়েলি সামরিক বিশেষজ্ঞও এমনটাই মনে করেন। তারা বলছেন, গাজার সামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। গাজার অনেক জায়গা দখল করে সেখানকার পরিস্থিতি ইসরায়েলের অনুকূলে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।

এমনকি গাজার ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করারও চেষ্টা চলছে। তাদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারা গাজা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, গাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্য কোথাও তাদের ‘বৈধ অভিবাসন’ করানো কঠিন।

গত মঙ্গলবার ভোরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের মাঝারি ও ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের নেতারা নিহত হয়েছে। এতে নারী ও শিশুর হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রায় ৮০টি ‘জঙ্গি আস্তানা’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। নেতানিয়াহু এই হামলাকে ‘শুরুর’ ইঙ্গিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *