যুদ্ধ আর বিভেদের আবহেও সমাধিস্থলগুলির প্রতি সম্মান জানাচ্ছে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য: এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত।
যুদ্ধ, বিভেদ আর কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও মানবতা আর শ্রদ্ধাবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুই দেশের মধ্যে যখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে, ঠিক সেই সময়েই পরস্পরের দেশে সমাধিস্থলগুলির রক্ষণাবেক্ষণে এক নীরব সমঝোতা বজায় রেখেছে তারা।
খবরটি শুনলে হয়তো অনেকের মনে হবে, এ কেমন কথা! একদিকে যখন চলছে ধ্বংসযজ্ঞ, তখন সমাধিস্থলগুলোর প্রতি এত মনোযোগ কেন? আসলে, এর পেছনে রয়েছে গভীর মানবিকতা আর মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক চিরায়ত ঐতিহ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নিহত হওয়া ব্রিটিশ সৈন্যদের সমাধিস্থলগুলো রাশিয়ার মুরমানস্ক, আর্খানগেলস্ক এবং ভ্লাদিভস্টকে অবস্থিত। জানা যায়, এই সমাধিস্থলগুলিতে ৬০০ জনের বেশি ব্রিটিশ সেনার মরদেহ রয়েছে।
তাদের মধ্যে অনেকে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, যখন মিত্রশক্তি শ্বেত বাহিনীর হয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিল। এছাড়াও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আর্কটিক কনভয়ে নিহত হওয়া ৪১ জন ব্রিটিশ সেনাও এখানে সমাধিস্থ।
ব্রিটিশ সরকার সাধারণত একটি সংস্থার মাধ্যমে এই সমাধিস্থলগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। সংস্থাটির নাম হলো কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে, যুক্তরাজ্য এখন সরাসরি সমাধিস্থলগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ পাঠাতে পারছে না।
কিন্তু পরিস্থিতি এমন হলেও, দুই দেশ একটি অলিখিত বোঝাপড়ায় পৌঁছেছে। কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন যুক্তরাজ্য এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে থাকা ৬৭৪টি সোভিয়েত সমাধিস্থলের রক্ষণাবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছে।
তাদের ধারণা, রাশিয়াও একইভাবে তাদের দেশে থাকা ব্রিটিশ সমাধিস্থলগুলোর দেখাশোনা করছে।
কমিশনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, যদিও তারা সরাসরি অর্থ পাঠাতে পারছে না, তবুও তারা রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখে নিশ্চিত করেছেন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা অবশ্যই বকেয়া পরিশোধ করবে। গত বছর, একজন রুশ ইতিহাসবিদ আর্খানগেলস্কে সমাধিস্থলগুলোর ছবি তুলেছিলেন এবং তিনি জানিয়েছিলেন যে সমাধিস্থলগুলো ভালো অবস্থাতেই আছে।
এমনকি, রাশিয়ার পক্ষ থেকে গত বছর ‘র্যাম্ব্রান্স ডে’ তে মুরমানস্কের সমাধিস্থলে ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং রুশ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিও ছিল।
এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের ভাইস-চেয়ার, ভাইস অ্যাডমিরাল পিটার হাডসন বলেন, “আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান কঠিন সম্পর্ক সত্ত্বেও, সমাধিস্থলগুলির প্রতি সম্মান জানানো হচ্ছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়া অঞ্চলে, ক্রিমীয় যুদ্ধের সময় নিহত হওয়া ব্রিটিশ সৈন্যদের গণকবরগুলো হয় ধ্বংস করা হয়েছে, অথবা সেগুলোর কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।
এই বিষয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ রয়েছে।
জার্মানির ওয়ার গ্রেভস কমিশনও রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, যা প্রমাণ করে যে, যুদ্ধ-বিগ্রহ সত্ত্বেও মৃতদের প্রতি সম্মান জানানো একটি অপরিহার্য মানবিক গুণ। তাদের তত্ত্বাবধানে রাশিয়ায় প্রায় ৬ লক্ষ জার্মান এবং ৭ লক্ষ ৬০ হাজার সোভিয়েত নাগরিকের সমাধিস্থল রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুদ্ধ-বিগ্রহের এই কঠিন সময়েও সমাধিস্থলগুলির প্রতি সম্মান জানানো, এক ইতিবাচক দিক।
এটি বুঝিয়ে দেয়, বিভেদ আর ধ্বংসের মধ্যেও মানবতা তার পথ খুঁজে নেয়।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান