চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং-এর আহ্বান, বিশ্ব বাণিজ্যকে ‘সুরক্ষা নীতির’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, বেইজিংয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সম্মেলন।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং সম্প্রতি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বিশ্ব ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন বাণিজ্য সুরক্ষামূলক নীতির (Protectionism) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন বিশ্বায়নের (Globalization) পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখার ওপর।
এই গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে অ্যাপল-এর টিম কুক, ফেডএক্স-এর রাজ সুব্রামানিয়াম এবং ফাইজার-এর অ্যালবার্ট বোরলার মতো শীর্ষস্থানীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (CEO) উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক (Tariff) বৃদ্ধি করেছেন, তখন এই সম্মেলনটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে দুই দেশের মধ্যে “অন্যায্য” বাণিজ্য সম্পর্কের পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং সতর্ক করে বলেন, “সরবরাহ শৃঙ্খল ছিন্ন করা এবং সম্পর্ক ত্যাগ করা হলে তা সংকটকে আরও গভীর করবে।” তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন খাতে বাজার আরও প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
লি’র মতে, “যদি বিশ্ব আবার ‘জঙ্গলের আইনে’ ফিরে যায়, তবে তা হবে ইতিহাসের পশ্চাদগমন এবং মানবজাতির জন্য একটি ট্র্যাজেডি।”
চীনের অর্থনীতির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য এই বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, বেইজিং ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্ক বর্তমানে বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় চীন প্রস্তুত বলেও জানান লি কিয়াং।
চীনের উন্নয়ন ফোরাম (China Development Forum) নামে পরিচিত এই সম্মেলনটি দীর্ঘদিন ধরেই চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিদেশি ব্যবসায়িক নেতাদের মধ্যে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে কাজ করে আসছে।
এবার এই ফোরামটি দু’দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা অনিশ্চয়তার এই সময়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এই সম্মেলনের ফাঁকে লি কিয়াং-এর সঙ্গে মার্কিন সিনেটর ও ট্রাম্পের মিত্র স্টিভ ডাইনেসের বৈঠক হয়।
ডাইনেস এই আলোচনাকে ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠকের “প্রথম পদক্ষেপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
কোয়ালকম, ফাইজার, ফেডএক্স এবং বোয়িং-এর মতো প্রধান মার্কিন কোম্পানিগুলোর নির্বাহীরাও সম্মেলনে যোগ দেন।
লি কিয়াং জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে “বিস্তৃত অভিন্ন স্বার্থ এবং সহযোগিতার বিশাল সুযোগ” রয়েছে।
তিনি দু’দেশের মধ্যে “জয়-জয় সহযোগিতা”-র আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার চীন ও শি জিনপিং-এর সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
শুক্রবার তিনি ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বাণিজ্য প্রতিনিধি এবং চীনা কর্মকর্তাদের মধ্যে চলতি সপ্তাহে আলোচনা হতে পারে।
ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সকল প্রকার আমদানির ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
এর ফলে, চীনও মার্কিন আমদানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে কৃষি ও কিছু জ্বালানি পণ্যও রয়েছে। এছাড়াও, চীন কাঁচামাল রপ্তানির ওপর নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরও বাড়তে পারে।
হোয়াইট হাউস আগামী সপ্তাহের শুরুতে বেশ কয়েকটি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করতে পারে।
এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হলো, উৎপাদন খাতকে পুনরায় আমেরিকায় ফিরিয়ে আনা এবং বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও সুষম করা।
বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা:
বাণিজ্য সম্পর্ক পুনর্গঠনের এই চেষ্টা এবং বিশ্ব বাণিজ্যে সম্ভাব্য ধাক্কা নিয়ে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ফোরামে বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানির নির্বাহী ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
ইন্টার আইকিয়া গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোন আব্রাহামসন রিং বলেন, “আমরা একটি মুক্ত, নিয়ম-ভিত্তিক বাণিজ্যে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা বিশ্বাস করি বাণিজ্য খুবই ইতিবাচক এবং এটি সুযোগ তৈরি করে।
বাণিজ্য টেকসই উন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে সহায়তা করবে।
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের গ্লোবাল চেয়ার রিচ লেসার ফোরামের এক প্যানেলে বলেন, বাণিজ্য সম্পর্কের এই পরিবর্তন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে আরও নমনীয় হতে এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করছে।
চীনের কর্মকর্তারা এই ধরনের অস্থিরতা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের একটি দায়িত্বশীল শক্তি এবং বিশ্বায়নের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি বলেন, “একটি দায়িত্বশীল প্রধান দেশ হিসেবে চীন ইতিহাসের সঠিক পথে, ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করবে।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো চীনের সঙ্গে ব্যবসা করতে কিছুটা দ্বিধা বোধ করছে।
এর কারণ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং চীনের জাতীয় নিরাপত্তা নীতির ওপর জোর দেওয়ার কারণে কিছু বিদেশি কোম্পানির কর্মীদের আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এছাড়াও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সবুজ প্রযুক্তির মতো পণ্য রপ্তানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তাদের অভিযোগ, সরকারি ভর্তুকি এই কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের চেয়ে অন্যায্য সুবিধা দিচ্ছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন