গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা: ধ্বংসস্তূপে পরিণত হাসপাতাল, মানবিক বিপর্যয় আসন্ন
গত কয়েকদিনে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় সেখানকার হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ঢল নেমেছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, যা মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোরে হওয়া বিমান হামলায় আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে আহত মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়।
হাসপাতালের চিকিৎসক মার্ক পার্লমুটার জানান, জরুরি বিভাগে সবসময় ৬৫ জনের বেশি রোগী ছিলেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। সেখানকার মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালেও একই চিত্র দেখা গেছে। চিকিৎসক তানিয়া হাজ-হাসান জানান, আহতদের আনাগোনা চলতেই ছিল।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, মঙ্গলবার সকালেই শুধুমাত্র গাজায় ২০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে এবং আরও শত শত মানুষ আহত হয়েছে। ১৮ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০ জনে পৌঁছেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহত হয়েছে ১,১৩,২৭৪ জন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার সকালে ১০ মিনিটের মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। তবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।
নাসের হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতে আসা আহতদের মধ্যে যাদের জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়, তাদের দ্রুত পরীক্ষার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। শিশুদের আঘাত গুরুতর হলেও তাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়।
গাজার একটি হাসপাতালে আহত এক শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: এনাদোলু/গেটি ইমেজ
ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রমা সার্জন ফেরোজ সিধওয়া জানান, তিনি এক শিশুর বাবাকে বলেছিলেন যে তার মেয়ের আর কয়েক মিনিট বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে।
গাজায় বর্তমানে ৩৫টির মধ্যে মাত্র ২২টি প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি যুদ্ধের আগের তুলনায় অনেক কম পরিষেবা দিতে পারছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় অফিসের মুখপাত্র ওলগা চেরেকভোর মতে, জরুরি ত্রাণ সরবরাহ সত্ত্বেও হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
আল-আকসা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব রয়েছে। সেখানকার একজন সার্জন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় মানসিক চাপ বাড়ছে। আমাদের হাতে মাত্র ১০টি বেড রয়েছে এবং বার্ন ড্রেসিং, গ্লাভস, ক্লিনিং উপকরণ—এসবের খুব অভাব।”
গাজা শহরের আল-আহলি হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট ড. খামিস এলেসি জানান, ক্যান্সারের রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যথানাশক নেই। তিনি বলেন, “গাজায় কয়েক লক্ষ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। তাদের সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন, কিন্তু পরিস্থিতি খুবই খারাপ। নিরাপদ পানি নেই, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই সর্বত্র সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে।”
ইসরায়েল গাজা থেকে আহত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিলেও, প্রতিদিন হাতে গোনা কয়েকজন যেতে পারছেন। চেরেকভো জানিয়েছেন, ১৪,০০০ জনেরও বেশি মানুষের জরুরি ভিত্তিতে গাজার বাইরে চিকিৎসা প্রয়োজন।
নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক ফাহদ হাদ্দাদ জানান, তাদের হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা ভয় পাচ্ছি, আমাদের সবকিছু ফুরিয়ে যাবে। যদি দীর্ঘদিন অবরোধ চলে, তাহলে আমরা টিকতে পারব না।”
যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকদের মনোবল ভেঙে গেছে। হাদ্দাদ বলেন, “মঙ্গলবার সকালে যখন বিস্ফোরণ শুরু হলো, তখন ১৮ মাস আগের যুদ্ধের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমরা যুদ্ধবিরতি চেয়েছিলাম। জীবন কঠিন ছিল, কিন্তু সেখানে অন্তত মানুষ মারামারি ছিল না।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান