লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ: নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত?

লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে উত্তেজনা: অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নতুন সমীকরণ।

বৈরুত, লেবানন থেকে: লেবানন ও সিরিয়ার মধ্যেকার সীমান্তে সম্প্রতি সংঘর্ষ নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনায় উভয় দেশের সামরিক বাহিনী জড়িয়ে পড়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উভয় সরকারকেই বেগ পেতে হচ্ছে।

সীমান্ত অঞ্চলে সংঘটিত এই সংঘর্ষের কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন বিষয়কে দায়ী করছেন। তাদের মতে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়া এবং লেবাননের রাজনৈতিক ও সামরিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রভাব কমে যাওয়া এর প্রধান কারণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হিজবুল্লাহর অংশগ্রহণের পর তারা সীমান্তের উভয় পাশে তাদের প্রভাব বিস্তার করে। তবে, বাশার আল-আসাদের শাসনের পতনের পর হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়ে, যা ইসরায়েলের বোমা হামলার কারণে আরও বেড়েছে।

এর ফলে হিজবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথও বন্ধ হয়ে যায়। কার্নেগি মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রের একজন অনাবাসিক গবেষক আরমেনাক টোকমাজিয়ান আল জাজিরাকে বলেছেন, “আসাদ সরকারের পতন এবং হিজবুল্লাহর দুর্বলতার কারণে সিরিয়া-লেবানন সীমান্ত এবং এর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে।”

লেবানন ও সিরিয়ার সীমান্ত প্রায় ৩৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা সত্ত্বেও এই সীমান্ত চিহ্নিত করা যায়নি।

দুর্গম ভূ-প্রকৃতির কারণে চোরাচালান এখানে একটি নিয়মিত ঘটনা, বিশেষ করে সংঘর্ষের স্থানগুলোতে এর প্রভাব বেশি। টোকমাজিয়ানের মতে, “সিরিয়ার যুদ্ধের সময় পুরো লেবানন-সিরিয়া সীমান্তজুড়ে এই ধরনের কার্যকলাপ বেড়ে গিয়েছিল। হিজবুল্লাহ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সিরিয়ায় প্রবেশ করে এবং বৈধ-অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে।”

অন্যদিকে নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট থিংক ট্যাঙ্কের স্ট্র্যাটেজিক ব্লাইন্ড স্পটস পোর্টফোলিওর পরিচালক ক্যারোলিন রোজের মতে, সিরিয়ার মাশর আল-আসাদের চতুর্থ সাঁজোয়া ডিভিশন লেবাননের অপরাধ চক্রের সাথে চোরাচালানে সহযোগিতা করত। এই অপরাধ চক্রগুলো প্রায়শই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রভাবশালী উপজাতিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা রাজনীতি ও স্থানীয় সামাজিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৮০-এর দশকে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের সাথে এই উপজাতিদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা প্রায়ই পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল। রোজ বলেছেন, “আসাদ সরকারের পতনের পর এই উপজাতিরা তাদের প্রধান মিত্র এবং সীমান্ত সুরক্ষার উৎস হারিয়েছে।”

লেবানন ও সিরিয়ার নতুন সরকার সীমান্ত চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে, যা অপরাধ চক্র এবং হিজবুল্লাহ উভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।

রোজের মতে, “এই সংঘর্ষ কেবল চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অপরাধ চক্র এবং গোত্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং সিরিয়া ও লেবাননে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে বৃহত্তর একটি দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত।”

গত ১৫ মার্চ, শনিবার তিনজন সিরীয় সেনার মৃত্যুর পর সর্বশেষ সংঘর্ষ শুরু হয়। তাদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করেছে যে হিজবুল্লাহ যোদ্ধা, সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, জেইতা বাঁধের কাছে তিনজন সেনাকে অপহরণ করে এবং তাদের লেবাননে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানার মতে, “হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ার একটি দল, সিরীয়-লেবানন সীমান্তের কাছে, হোমসের পশ্চিমে জেইতা বাঁধের কাছে, সিরিয়ার আরব সেনাবাহিনীর তিন সদস্যকে অপহরণ করে এবং তাদের লেবাননের ভূখণ্ডে নিয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করে।”

নিহত তিনজনের মরদেহ লেবাননের রেড ক্রসের মাধ্যমে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।

হিজবুল্লাহ তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, “সিরিয়ার ভূখণ্ডে সংঘটিত কোনো ঘটনার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।”

লেবাননের গণমাধ্যম জানায়, ওই তিনজন সেনা লেবাননের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এদের মধ্যে কারও কারও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।

লেবাননের তথ্যমন্ত্রী পল মরকোস বলেছেন, নিহত তিনজন সিরীয় সেনা চোরাকারবারী ছিলেন। স্থানীয় কিছু গণমাধ্যম জানায়, তারা সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়া সংগঠন, হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) সঙ্গে যুক্ত ছিল।

সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হিজবুল্লাহকে দায়ী করে সীমান্ত অঞ্চলে সেনা পাঠায়। এর পরেই তারা লেবাননের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে গোলাবর্ষণ শুরু করে।

এই সংঘর্ষে সাতজন লেবাননের নাগরিক এবং ১০ জন সিরীয় সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫২ জন লেবাননের নাগরিক।

সিরিয়ার দিকেও অনেকে আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে থাকা কিছু সাংবাদিকও রয়েছেন।

সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর, লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন ওই এলাকায় সেনা পাঠান এবং তাদের পাল্টা জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। সীমান্ত পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল রাখার পেছনে হিজবুল্লাহর স্বার্থ থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

লেবাননের সেনাবাহিনীর সীমান্ত কমিটির তত্ত্বাবধায়ক সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মার্সেল বালুকজি আল জাজিরাকে বলেছেন, স্থানীয় উপজাতিদের মাধ্যমে চোরাচালানের মাধ্যমে হিজবুল্লাহর অর্থের যোগান আসে।

বালুকজির মতে, হিজবুল্লাহ জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, সম্ভবত তারা ওই এলাকাকে অস্থিতিশীল রাখতে উপজাতিদের ব্যবহার করছে, যাতে তারা চোরাচালান চালিয়ে যেতে পারে।

তবে, ইসরায়েলের বোমা হামলায় হিজবুল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিহত হওয়ার পর দলটির প্রভাব কমে গেছে। সীমান্তজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হারানোর ফলেও তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, উপজাতিরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য হিজবুল্লাহকে ত্যাগ করতে পারে এবং লেবাননের সেনাবাহিনী ও নতুন সিরীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারে।

নতুন সিরীয় সরকারও হিজবুল্লাহকে তাদের পুরোনো সমর্থনের জন্য একঘরে করে রেখেছে।

টোকমাজিয়ানের মতে, “এ ধরনের সংঘর্ষের কারণ বিভিন্ন হতে পারে, তবে এটা স্পষ্ট যে সীমান্ত এবং আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক নতুন রূপ নিচ্ছে। এবং এটি সম্ভবত এই প্রক্রিয়ার শুরু।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *