ফালুজার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা: গাজা ও লেবাননের জন্য সতর্কবার্তা!

যুদ্ধবিধ্বস্ত ফালুজা: যুদ্ধের ক্ষত আর বিষাক্ত পরিবেশ, গাজা, লেবানন ও সিরিয়ার জন্য সতর্কবার্তা।

যুদ্ধ শেষ হলেও ফালুজার মানুষের জীবন থেকে যেন যুদ্ধের বিভীষিকা সহজে যেতে চাইছে না। ইরাকের এই শহরে, যা একসময় যুদ্ধের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, সেখানকার বাসিন্দাদের শরীরে এখনও বাসা বেঁধে আছে যুদ্ধের ভয়াবহতা।

সম্প্রতি হওয়া এক গবেষণায় উঠে এসেছে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের কারণে সেখানকার মানুষের শরীরে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, যা তাদের স্বাস্থ্যহানির কারণ হচ্ছে। এই গবেষণার ফল গাজা, লেবানন এবং সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্টস অফ ওয়ার’ প্রকল্পের গবেষকদের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফালুজার বাসিন্দাদের শরীরে সীসা ও ইউরেনিয়ামের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি মারাত্মক উদ্বেগের কারণ। সেখানকার ২৯ শতাংশ মানুষের হাড়ে ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে, যেখানে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি, এবং সবার শরীরেই সীসার উপস্থিতি ধরা পড়েছে।

বিশেষভাবে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের শরীরে সীসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের সমবয়সী মানুষের তুলনায় ৬০০ শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে। শরীরে এই ভারী ধাতুগুলির উপস্থিতি স্নায়ু বিকাশে সমস্যা, হৃদরোগ এবং জন্মগত ত্রুটি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আক্রমণের সময় ফালুজা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘রিনা’ (ছদ্মনাম)। যুদ্ধের ডামাডোলের পর যখন তারা আবার ফিরে আসেন, তখন তাদের বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।

রিনা জানান, বাড়ি পুনরায় তৈরি করার সময় তিনি ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার কাজ প্রায় একাই করেছিলেন। প্রতিনিয়ত তিনি কংক্রিটের ধুলো, অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ এবং পোড়া কাঠসহ বিষাক্ত মিশ্রণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন।

এর ফলস্বরূপ, তার সন্তান জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ফালুজার যেসব এলাকায় বোমা হামলা বেশি হয়েছে, সেখানকার মাটিতে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি। শুধু বোমা হামলা নয়, মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘বার্ন পিট’-এর (সামরিক সরঞ্জাম পোড়ানোর স্থান) কারণে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়াও সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।

ফালুজার এই অভিজ্ঞতা গাজা, লেবানন এবং সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কারণ, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বাড়িঘর পরিষ্কার করার সময় সেখানকার মানুষও একই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

বিশেষ করে, যারা দ্রুত তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করতে গিয়েছিলেন, তাদের শিশুদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর কারণ, তারা ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার সময় বিষাক্ত ধূলিকণা ও রাসায়নিকের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

গবেষকরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে অপুষ্টির শিকার হওয়া মানুষজন যখন এইসব ধ্বংসস্তূপের সংস্পর্শে আসে, তখন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড (folic acid) গ্রহণ না করলে শিশুর নিউরাল টিউব ত্রুটি হতে পারে।

এছাড়াও, যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষে থাকা ভারী ধাতুগুলিও গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরগুলোতে ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যুদ্ধের শিকার হওয়া মানুষদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্থানীয় ক্লিনিক এবং রেডিওর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করার সময় মাস্ক বা স্কার্ফ ব্যবহার করা, এবং আবর্জনা পোড়ানোর পরিবর্তে পুঁতে ফেলা যেতে পারে।

গর্ভবতী মহিলা এবং যারা সন্তান নিতে ইচ্ছুক, তাদের এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ভিটামিন সি ও ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে শরীরে ভারী ধাতুর শোষণ ও নিঃসরণ সীমিত করা যেতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে শহরগুলোতে বোমা হামলা বন্ধ করা। কারণ, যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যহানির প্রধান কারণ।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *