পোষা প্রাণীদের কাঁচা খাবার: স্বাস্থ্য নাকি বিপদ?
বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে, পোষা প্রাণী, যেমন – বিড়াল ও কুকুরের জন্য কাঁচা খাবার (Raw food) খাওয়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। এই খাবারে সাধারণত রান্না না করা মাংস, অঙ্গ, হাড় এবং অন্যান্য উপাদান থাকে।
অনেক পশুপ্রেমী মনে করেন, এই ধরনের খাবার তাদের পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কিছু গুরুতর ঝুঁকিও রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, কাঁচা খাবার খাওয়ানোর সঙ্গে বার্ড ফ্লু (পাখির ফ্লু) সংক্রমণের সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যা উদ্বেগের কারণ। গত ডিসেম্বর মাসে, একটি পোষা প্রাণীর খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থার কাঁচা টার্কি মাংসে H5N1 ভাইরাস পাওয়া যায়।
এই খাবার খাওয়ার পরেই একটি বিড়ালের মৃত্যু হয় এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বিড়ালের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিড়াল এবং নিউইয়র্কের আরও দুটি বিড়ালের শরীরেও বার্ড ফ্লু ধরা পড়েছিল, যাদের কাঁচা খাবার খাওয়ানো হতো।
দুর্ভাগ্যবশত, এই বিড়ালগুলোরও মৃত্যু হয়েছে।
কাঁচা খাবার প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো দাবি করে, তাদের খাদ্য হিমায়িত, শুকানো বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করা হয়। কিন্তু পশুচিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদ্ধতিগুলো বার্ড ফ্লুর মতো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মারতে যথেষ্ট কার্যকর নয়।
বিড়ালরা H5N1 ভাইরাসের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। কুকুরের ক্ষেত্রে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম হলেও, তারাও ঝুঁকিতে থাকে।
তাহলে, কেন অনেকে তাদের পোষা প্রাণীকে কাঁচা খাবার খাওয়াতে চান? এর প্রধান কারণ হলো, তারা মনে করেন, এটি তাদের প্রাণীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প।
তাদের ধারণা, কাঁচা খাবার খাওয়ালে পোষা প্রাণীর চামড়ার ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, দাঁত পরিষ্কার থাকে এবং হজমক্ষমতা উন্নত হয়। এছাড়াও, প্রস্তুত খাবারে থাকা কৃত্রিম উপাদান ও প্রিজারভেটিভ (preservatives) এড়িয়ে যাওয়া যায়।
তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, কাঁচা খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতার পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। ইতালির সাসারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক আন্তোনিও ভার্কাসিয়া (Antonio Varcasia) মনে করেন, কাঁচা খাবার ভালোভাবে প্রস্তুত না করলে পুষ্টির অভাব হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, খাবারে অতিরিক্ত প্রোটিন বা ফাইবারের (fiber) অভাব দেখা দিতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি পুষ্টিবিদ জেনিফার লারসেন (Jennifer Larsen) বলেন, “অনেক মালিক মনে করেন, তাদের পোষা প্রাণী ভালো আছে, তবে এটি কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নয়।
কাঁচা খাবার খাওয়ার ফলে পোষা প্রাণীরা পরজীবী সংক্রমণ, যেমন – টক্সোপ্লাজমা গন্ডি (Toxoplasma gondii) এবং ইকিনোকক্কাস গ্রানুলোসাস (Echinococcus granulosus) – এর শিকার হতে পারে। টক্সোপ্লাজমা গন্ডি খাদ্যবাহিত অসুস্থতার প্রধান কারণ এবং এটি পোষা প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ইকিনোকক্কাস গ্রানুলোসাস একটি ফিতাকৃমি, যা অন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং মানুষের মধ্যেও ছড়াতে পারে। এছাড়া, কাঁচা মাংসে সালমোনেলা (Salmonella), ই. কোলাই (E. coli) এবং লিস্টেরিয়ার (Listeria) মতো ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে।
বার্ড ফ্লু এখন কাঁচা খাবারের মাধ্যমে পোষা প্রাণীর শরীরে প্রবেশের আরেকটি কারণ। সাধারণত, সংক্রমিত মুরগি এই খাবারে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এটি ঘটে থাকে।
আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ভেটেরিনারি প্যাথলজিস্ট সিলভিয়া কারনাকিনি (Silvia Carnaccini) বলেন, “যদি কোনো পোষা প্রাণী অসুস্থ বা মৃত পাখি খায়, অথবা সংক্রমিত গাভীর দুধ পান করে, অথবা হাঁস বা মুরগির কাঁচা বা কম রান্না করা মাংস খায়, তবে সে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হতে পারে।
আপনার পোষা প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (AVMA) কিছু পরামর্শ দিয়েছে:
- আপনার বিড়ালকে বাড়ির ভেতরে রাখুন, যাতে বন্য পাখির সংস্পর্শে না আসে。
- খাবার দেওয়ার আগে মাংস ভালোভাবে রান্না করুন।
- কাঁচা মাংসের তৈরি কোনো খাবার বা ট্রিট (treat) দেবেন না।
- দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ালে, নিশ্চিত করুন যে সেগুলো পাস্তুরিত (pasteurized) করা হয়েছে।
- আপনার পোষা প্রাণীর মধ্যে বার্ড ফ্লুর কোনো লক্ষণ দেখলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিন। লক্ষণগুলোর মধ্যে জ্বর, কাঁপুনি, নাক দিয়ে তরল বের হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট অন্যতম।
যদিও মানুষ থেকে পোষা প্রাণীতে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের ঝুঁকি কম, তবুও সতর্ক থাকা ভালো। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথের ভাইরোলজিস্ট মার্থা নেলসন (Martha Nelson) বলেন, “আপনার বিড়ালকে বাড়ির বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখুন, যাতে সে সংক্রমিত পাখি শিকার করতে না পারে এবং পোষা প্রাণীকে কাঁচা খাবার খাওয়ানো বন্ধ করুন।
যদি কোনো পোষ্য-প্রেমী কাঁচা খাবার খাওয়াতেই চান, তবে পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, খাবারটি নিরাপদ উপায়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে, নেলসনের মতে, “কাঁচা খাবার ব্যবহার না করাই সবচেয়ে নিরাপদ।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক