শিরোনাম: স্পেনে দাবানল রুখতে বন্য ঘোড়ার সাহায্য, পরিবেশবান্ধব সমাধানের দিশা
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে দাবানলের ঘটনা বাড়ছে, যা পরিবেশের জন্য এক গুরুতর উদ্বেগের কারণ। এই পরিস্থিতিতে, স্পেনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের গ্যালিসিয়ায় বন্য ঘোড়ার মাধ্যমে দাবানল প্রতিরোধের এক অভিনব প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
গ্যালিসিয়ার বারো গ্রামের কাছে লুসিয়া পেরেজ নামের এক নারী, ২০১৯ সাল থেকে বন্য ঘোড়া চারণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে, এই অঞ্চলে দাবানলের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পেরেজ জানান, আগে প্রতি বছর দাবানলের ঘটনা ঘটত, কিন্তু ঘোড়া চারণ শুরু হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
বন্য ঘোড়াগুলো গাছের নিচের ঝোপঝাড় খেয়ে সাফ করে দেয়, ফলে শুকনো ঘাস বা অন্যান্য সহজে আগুন লাগতে পারে এমন উপাদানের বিস্তার কমে যায়।
গবেষণা বলছে, এই অঞ্চলের বন্য ঘোড়ার দল, বিশেষ করে ইউরোপের বৃহত্তম এই বন্য ঘোড়াগুলো, এখানকার পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা এখানকার একটি বিশেষ ধরনের ঘাস বা গুল্ম (গোর্স) খেয়ে নেয়, যা খুব সহজে আগুন ধরতে পারে।
এর ফলে দাবানলের ঝুঁকি কমে আসে। কোরুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লরা লাগোস জানান, ঘোড়ার এই চারণ প্রক্রিয়া অন্যান্য উদ্ভিদ, যেমন – বেগুনি ফুলওয়ালা হিদার ও সাদা অ্যাস্ফডেল-এর মতো গাছগুলোকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
এটি পিট বোগ (peat bog) এলাকার আশেপাশে হিদার সংরক্ষণ করতেও সহায়ক, যা কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বন্য ঘোড়ার চারণ দাবানল প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এই পদ্ধতির সঙ্গে অন্যান্য ভূমি ব্যবহারের যেমন – পাইন বন তৈরি, ইউক্যালিপটাস বাগান এবং গৃহপালিত পশুর চারণের তুলনা করা হয়েছে।
লাগোস উল্লেখ করেন, ভেড়া বা গরুর মতো গৃহপালিত পশুরাও দাবানল কমাতে সাহায্য করতে পারে, তবে গ্যালিসিয়ার রুক্ষ ভূখণ্ডের সঙ্গে বন্য ঘোড়ারা বিশেষভাবে মানানসই।
তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো – এদের গোঁফ, যা তাদের মুখকে কাঁটাযুক্ত গোর্সের আঘাত থেকে বাঁচায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া গ্যালিসিয়ায় দাবানলের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে ৯৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আগুনে পুড়ে গেছে।
এই পরিস্থিতির জন্য ইউক্যালিপটাস গাছের বিস্তারও অনেকাংশে দায়ী। উনিশ শতকে এক মিশনারি এই গাছগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে এখানে নিয়ে আসেন।
ইউক্যালিপটাস গাছগুলো সহজে আগুন ধরে এবং এদের বীজ ছড়ানোর জন্য আগুনের প্রয়োজন হয়। এর ফলে দাবানলের ঝুঁকি বাড়ে এবং বন্য ঘোড়ার চারণক্ষেত্রও কমে যায়, কারণ এদের নিচে শুধু ফার্ন জন্মায়।
গ্যালিসিয়ার স্থানীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এই অঞ্চলের মোট গাছের মধ্যে ২৮ শতাংশই ইউক্যালিপটাস গাছ। এখানকার পাল্প মিলগুলোতে ইউক্যালিপটাস কাঠের চাহিদা বাড়ায় এই গাছগুলি দ্রুত বাড়ছে।
গ্যালিসিয়ার বন্য ঘোড়ার ইতিহাস কয়েক হাজার বছর পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে জানা যায়, নব্যপ্রস্তর যুগেও এখানে ঘোড়ার অস্তিত্ব ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ও ঘোড়ার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্থানীয় ভাষায় ‘বেস্তেইরোজ’ নামে পরিচিত মানুষরা, ঘোড়ার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করত এবং মাঝে মাঝে মাংসের জন্য তাদের বিক্রি করত বা গৃহপালিত করত।
ঐতিহ্যগতভাবে, বছরে একবার ‘রাপা দাস বেস্তাস’ (shearing of the beasts) নামে পরিচিত অনুষ্ঠানে ঘোড়াগুলোকে একত্র করা হতো। এই সময় তাদের চামড়ার পরজীবী দূর করা হতো, টিকা দেওয়া হতো এবং নেকড়েদের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের কেশর ছাঁটা হতো।
বর্তমানে, ‘রাপা দাস বেস্তাস’ একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে পর্যটকেরা এসে স্থানীয়দের বন্য ঘোড়াদের সঙ্গে কুস্তি করতে দেখে।
গ্যালিসিয়ার এই ঐতিহ্য, সেখানকার বন্য ঘোড়া এবং মানুষের মধ্যে গভীর সম্পর্কের প্রমাণ। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসস্থলের ক্ষতি এবং ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এই প্রাণী ও তাদের আবাসস্থল রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা