ব্রাজিলের সাবেক রাষ্ট্রপতি জাইর বলসোনারোকে সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আদালত জানিয়েছে, ক্ষমতা ধরে রাখতে বলসোনারো যে সহিংস পরিকল্পনা করেছিলেন, সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
বলসোনারো ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এই রায়ের ফলে চরম ডানপন্থী এই নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং তাঁর ৪০ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
আদালত আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির আরও সাত ঘনিষ্ঠ সহযোগীকেও বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি, অভ্যুত্থানে জড়িত থাকা এবং ব্রাজিলের গণতন্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়াল্টার ব্রাগা নেট্টো ও জেনারেল পাওলো সের্জিও নোগুইরা ডি ওলিভেইরা, নৌবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান অ্যাডমিরাল আলমির গার্নিয়ার সান্তোস, নিরাপত্তা বিষয়ক প্রাক্তন মন্ত্রী অ্যান্ডারসন টরেস, প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান অ্যালেক্সান্দ্রে রামাগেম, প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রাক্তন মন্ত্রী জেনারেল আগস্টো হেলেনো এবং প্রাক্তন সহযোগী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাউরো সিড।
যদিও সিড ইতিমধ্যে প্রসিকিউটরদের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন, তাই দোষী সাব্যস্ত হলেও তাঁর সাজা কম হতে পারে।
অভিযোগ উঠেছে, ২০২২ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে ২০২৩ সালের ৮ই জানুয়ারির মধ্যে বলসোনারোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য একটি ষড়যন্ত্র করা হয়। ওই সময় বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার কাছে তিনি সামান্য ব্যবধানে পরাজিত হন।
এরপর ব্রাসিলিয়ায় দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। অনেকে মনে করেন, ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই দাঙ্গা ঘটানো হয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অ্যালেক্সান্দ্রে ডি মোরেস আদালতে বলেন, “এটি ছিলো একটি সত্যিকারের যুদ্ধ… এটি ছিলো একটি চরম সহিংস অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা।” তিনি বলসোনারোর সমর্থকদের দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট ভাঙচুরের ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করেন এবং পুলিশের ওপর হামলার বিষয়টি তুলে ধরেন।
বিচারক আরও যোগ করেন, “এসব ছবি অপরাধের গুরুত্ব ও ঘটনার প্রমাণ দেয়।”
অভিযোগ রয়েছে, লুলার ক্ষমতা গ্রহণ আটকাতে নির্বাচনের আগে আরও কিছু ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, যার মধ্যে কিছু ছিলো মারাত্মক। পুলিশের দাবি, ‘গ্রিন অ্যান্ড ইয়েলো ড্যাগার’ নামে পরিচিত একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে লুলাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা এবং বিচারক মোরেসকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
ব্রাজিলের অ্যাটর্নি জেনারেল পাওলো গোনেট আদালতকে জানান, তদন্তকারীরা “একটি ভয়ঙ্কর অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা উন্মোচন করেছেন, যেখানে রাষ্ট্রপতি ও ভাইস-প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারককে হত্যার পরিকল্পনাও ছিলো।”
তিনি আরও বলেন, “হত্যার ষড়যন্ত্রে বিস্ফোরক, সামরিক সরঞ্জাম ও বিষ ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল… তবে সেনাবাহিনীর প্রধানকে রাজি করাতে না পারায় তারা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।” গোনেট বলসোনারো ও তাঁর সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান।
শুনানি শুরুর সময় বলসোনারো তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে এমন একটি অপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে, যা আমি করিনি।” তিনি আরও দাবি করেন, তিনি কখনো “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙার” কথা ভাবেননি বা বলেননি।
তবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেছেন যে তিনি তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে “জাতির জন্য রাজনৈতিক বিকল্প” নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও তাঁদের মক্কেলদের নির্দোষ দাবি করেছেন। যদিও তাঁদের অনেকেই অভ্যুত্থান চেষ্টার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেননি।
বলসোনারোর আইনজীবী সেলসো ভিলারি বলেন, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ৮ই জানুয়ারির বিদ্রোহে জড়িত ছিলেন না এবং লুলা ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্রাগা নেটোর আইনজীবী জোসে লুইস মেন্ডেস ডি ওলিভিয়েরা লিমা তাঁর মক্কেলকে “নির্দোষ ব্যক্তি” হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন, তিনি “কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত নন।”
টরেসের আইনজীবী ইউমার নোভাকি বলেন, তাঁর মক্কেল “এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন না” এবং তিনি অভিযোগ করেন, তদন্তে “মিথ্যা তথ্য” পরিবেশন করা হয়েছে।
সান্তোসের আইনজীবী ডেমোস্তিনিস টোরেস তাঁর মক্কেলকে ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে অস্বীকার করেন এবং “ফেডারেল পুলিশের ঔপন্যাসিকদের” দায়ী করেন, যাঁরা এই ষড়যন্ত্রের একটি কাল্পনিক চিত্র তৈরি করেছেন বলে তিনি মনে করেন।
রামাগেমের আইনজীবী পাওলো রেনাতো গার্সিয়া সিনট্রা পিন্টো বলেন, তাঁর মক্কেল ব্রাজিলের গণতন্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা করবেন, এমন কোনো কারণ নেই, কারণ তিনি ২০২২ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেরনার্দো মेलो ফ্রাঙ্কো মনে করেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের কারাবাস এড়ানো কঠিন। তিনি বলেন, “সম্ভবত বলসোনারো দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে অথবা তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন… বিচার বিভাগের দৃষ্টিতে বলসোনারো কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বলসোনারোর রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে কোনো ডানপন্থী মিত্রকে জয়ী করতে পারার ওপর। যিনি ক্ষমতায় এসে তাঁকে ক্ষমা করতে রাজি হবেন।
তাঁর ছেলে এডুয়ার্দো বলসোনারো এবং স্ত্রী মিশেল বলসোনারো এই দৌড়ে রয়েছেন।
বলসোনারো তাঁর রাজনৈতিক জীবন রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের ওপরও নির্ভর করছেন।
মিলো ফ্রাঙ্কো বলেন, “বলসোনারো আশা করছেন, ট্রাম্প রাজনৈতিক ও বিচারিকভাবে তাঁর জন্য ত্রাণকর্তা হয়ে আসবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প কোনো না কোনোভাবে ব্রাজিলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে তাঁকে সাহায্য করবেন।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান