মশা মারতে মানুষের রক্তে বিষ! বিজ্ঞানীরা আনছেন মারাত্মক কৌশল!

ম্যালেরিয়া (Malaria): মশা মারার নতুন অস্ত্র, মানুষের রক্তেই বিষ!

বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে দেশের কিছু অঞ্চলে। প্রতি বছর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ৬ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয় ম্যালেরিয়ার কারণে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের নতুন উপায় খুঁজছেন।

সম্প্রতি, একদল বিজ্ঞানী এক যুগান্তকারী গবেষণা করেছেন, যেখানে মানুষের রক্তকে মশার জন্য বিষাক্ত করে তোলার কৌশল নিয়ে কাজ করা হয়েছে।

বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘নাইটিসিনোন (Nitisinone)’ নামক একটি ওষুধ মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে, সেই ব্যক্তির রক্ত মশার জন্য বিষাক্ত হয়ে যায়।

ফলে, যে মশা সেই রক্ত পান করে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওষুধ প্রয়োগের ১৬ দিন পরেও এর কার্যকারিতা থাকে।

আসল বিষয়টি হলো, নাইটিসিনোন নিজে সরাসরি ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে না। বরং, এটি মশা মারার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের একটি কৌশল।

মশা মারতে পারলে তারা ডিম পাড়তে পারবে না, ফলে ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী জীবাণু ছড়ানোর হারও কমে আসবে। অনেকটা দলবদ্ধভাবে রোগ প্রতিরোধের মতো, যেখানে সবাই মিলে চেষ্টা করলে তবেই একটি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।

গবেষকরা বলছেন, এই পদ্ধতি মশা-বাহিত রোগ নির্মূলের চূড়ান্ত সমাধান নাও হতে পারে, তবে অন্যান্য পদ্ধতির সঙ্গে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

যেমন— কীটনাশকযুক্ত মশারি, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ওষুধ এবং ভ্যাকসিন (Vaccine)। যেসব অঞ্চলে মশার মধ্যে ইতিমধ্যে প্রচলিত চিকিৎসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সেখানে এই নতুন কৌশল বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য এবং ইউনিভার্সিটি অফ নটর ডেমের (University of Notre Dame) অধ্যাপক আলভারো অ্যাকোস্টা সেরানো (Álvaro Acosta Serrano) বলেছেন, “এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমরা এমন একটি ওষুধ ব্যবহার করছি, যা ইতিমধ্যে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (Food and Drug Administration – FDA) কর্তৃক অনুমোদিত।

এটি বিরল কিছু জেনেটিক রোগ (rare genetic diseases) চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।

নাইটিসিনোনের একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস রয়েছে। এটি মূলত অস্ট্রেলীয় বটলব্রাশ (Australian bottlebrush) গাছের একটি বিষাক্ত উপাদান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছিল।

এই ওষুধটি টাইরোসিন নামক একটি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডকে (amino acid) লক্ষ্য করে কাজ করে। টাইরোসিনেমিয়া টাইপ ১ (tyrosinemia type I) এবং অ্যালকাপটোনুরিয়ার (alkaptonuria) মতো বিরল কিছু জেনেটিক রোগ আছে, যেখানে শরীর এই অ্যাসিডকে সঠিকভাবে বিপাক করতে পারে না।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নাইটিসিনোন এই রোগগুলির চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে। তাই ১৯৯২ সালে এটি মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করা হয়।

অধ্যাপক সেরানো বলেন, “টাইরোসিনেমিয়া টাইপ ১ রোগে আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়। এটি নিখুঁত সমাধান না হলেও, বর্তমানে এটিই একমাত্র উপায়।

যদিও এই ওষুধ সেবন করলে রোগীদের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ডোজ এর থেকে অনেক কম হবে।

২০১৬ সালে, ব্রাজিলের (Brazil) গবেষক মার্কোস স্টারকেল (Marcos Sterkel) এবং পেড্রো অলিভেইরা (Pedro Oliveira) আবিষ্কার করেন যে, মশা, মাছি এবং অন্যান্য রক্ত ​​শোষণকারী পোকামাকড় টাইরোসিনকে দ্রুত প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা অর্জন করেছে।

তাঁরা আরও জানতে পারেন, যদি এই প্রক্রিয়াটিতে ব্যাঘাত ঘটানো যায়, তাহলে পোকামাকড় মারা যাবে।

যুক্তরাজ্যের (United Kingdom) লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের (Liverpool School of Tropical Medicine) অধ্যাপক সেরানোর ল্যাবে, বিজ্ঞানীরা ‘সেতসে মাছি’ (tsetse fly) নামক আরেকটি রক্ত ​​শোষণকারী পরজীবী নিয়ে কাজ করেন।

এরপর তাঁরা নাইটিসিনোনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

তবে, এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথের (Johns Hopkins Bloomberg School of Public Health) অধ্যাপক জর্জ ডিমোপোলাস (George Dimopoulos) বলেন, “ম্যালেরিয়া একটি দারিদ্র্যের রোগ।

এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যদি ব্যয়বহুল হয়, তাহলে তা সবার জন্য কার্যকর হবে না।

তাছাড়া, নাইটিসিনোন নেওয়ার ফলে মানুষ সরাসরি ম্যালেরিয়া থেকে সুরক্ষিত হয় না, বরং এটি একটি জনসংখ্যা-ভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

অধ্যাপক ডিমোপোলাস আরও উল্লেখ করেন, নাইটিসিনোন তৈরির খরচ এখনো বেশি। তবে, গবেষণা বাড়লে এর দাম প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

এই ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষকে বোঝানো কঠিন হতে পারে, কারণ এটি সরাসরি তাদের সুরক্ষা দেয় না। ভবিষ্যতে অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া ওষুধের সঙ্গে নাইটিসিনোন ব্যবহার করা যেতে পারে।

এমনকি, গবাদি পশুর শরীরে এই ওষুধ প্রয়োগ করে মশা আকৃষ্ট করার মাধ্যমেও একে কার্যকরী করা যেতে পারে।

মশা যেহেতু ফুলের মধু থেকেও খাদ্য গ্রহণ করে, তাই বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে কীটনাশক মিশ্রিত মধু ব্যবহার করা হবে, যা অন্যান্য পরাগ-নিষিক্তকারীদের (pollinators) ক্ষতি না করে শুধুমাত্র মশা মারতে পারবে।

তবে, মশা নিয়ন্ত্রণ করার যে কোনও পদ্ধতির বিরুদ্ধেই প্রতিরোধের সম্ভাবনা থাকে। তাই, নাইটিসিনোন ভবিষ্যতে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে।

অধ্যাপক সেরানো এবং অধ্যাপক ডিমোপোলাস দুজনেই একমত যে, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন।

যেখানে নাইটিসিনোনের ব্যবহার, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রতিরোধের ব্যবস্থা একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। অধ্যাপক ডিমোপোলাস বলেন, “ম্যালেরিয়ার কোনো একক সমাধান নেই, আর সম্ভবত কখনোই হবে না।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক (National Geographic)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *