গাজায় উদ্বাস্তু জীবন: ইসরায়েলের ‘স্বেচ্ছায়’ স্থানান্তরের প্রস্তাব আর ফিলিস্তিনিদের দ্বিধা
গাজা উপত্যকায় জীবন এখন এক কঠিন বাস্তবতা। একদিকে ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে উদ্বাস্তু জীবন। এর মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েলের একটি প্রস্তাব। শোনা যাচ্ছে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ‘স্বেচ্ছায়’ অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য একটি দপ্তর খুলতে চাইছে তারা।
এই খবরে একদিকে যেমন হতাশ সেখানকার বয়স্ক মানুষজন, তেমনই ভবিষ্যৎহীনতার শিকার হয়ে অনেকে পালাতে চাইছেন।
গাজার দেইর আল-বালাহ-র বাসিন্দা, ৭৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল-নাবাহিন। উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করা এই বৃদ্ধ সম্প্রতি রেডিওতে শোনেন ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার কথা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই দপ্তর খোলার প্রস্তাব দিয়েছেন, যা মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে।
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, যারা গাজা ছাড়তে চান, তাদের অন্য দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। তবে ফিলিস্তিনের পুরনো গ্রামগুলোতে ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসার কোনো কথা তারা উল্লেখ করেনি।
এই ধারণা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তারা যদি আমাদের স্বেচ্ছায় সরিয়ে দিতে চায়, তবে আমাদের যেন নিজেদের জমিতে, যেখানে তারা আমাদের বিতাড়িত করেছে, সেখানে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আমরা কেন আমাদের দেশ ছাড়ব?
মোহাম্মদের উদ্বাস্তু হওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। ১৭ মাস আগে গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় তিনি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এখনো তিনি মনে করেন, গাজায় একটি তাঁবুতে বাস করা, অন্য কোথাও যাওয়ার চেয়ে ভালো। তার পরিবারের সবাই-ই তার সঙ্গে একমত।
অন্যদিকে, ৪৭ বছর বয়সী সালওয়া আল-মাসরি, তাঁবুর বাইরে বসে রান্নার জন্য আগুন জ্বালাচ্ছিলেন। তিনিও গাজা ছাড়ার ধারণাকে ঘৃণা করেন।
ইসরায়েলি অবরোধের কারণে খাবার সংগ্রহ করতে তার চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্য লতা-পাতা ও শাক খেয়ে কোনোমতে তাদের দিন কাটে। ইসরায়েলের বোমা ও ক্ষুধার কারণে তিনি যেন মৃত্যুর দিন গুণছেন।
সালওয়ার মতে, এত কষ্ট সহ্য করার পর দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তিনি বলেন, “আমরা সবকিছু হারিয়েছি। উত্তর গাজার বেইত হানুনে আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি, কিন্তু আমি উদ্বাস্তু হয়ে দক্ষিণে থাকতেই রাজি, কষ্ট ও ক্ষুধা সহ্য করতে রাজি, তবুও যাব না।”
সালওয়ার ধারণা, ইসরায়েল বোমা হামলা ও খাদ্য সংকট তৈরি করে এখানকার মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে চাইছে। তার প্রশ্ন, “কোথায় যাব আমরা? কেন আমাদের জন্য বাঁচার কোনো সুযোগ নেই?”
সম্প্রতি, বেইত হানুনে ইসরায়েলি হামলায় সালওয়ার বোনের আট সন্তান নিহত হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়তে বাধ্য করার এই চেষ্টা আসলে একটি জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা।
১৯৪৮ সালে, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় অন্তত সাত লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ এখনো চলছে, এবং এতে ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
গাজার অনেক প্রবীণ এখনো সেখানে টিকে থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এই উপত্যকায় তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পান না।
২৫ বছর বয়সী মাহমুদ আল-রাই একটি অস্থায়ী গ্যারেজে সাইকেলের টায়ারের মেরামত করছিলেন। স্থানান্তরের প্রস্তাব শুনে তিনি হেসে বলেন, “কোথায় নাম লেখাতে হবে?” তিনি দ্রুত গাজা ছাড়তে চান।
তার মতে, যুদ্ধের কারণে মানুষ এখানে ক্লান্ত, তারা আর এই দুর্ভোগ সহ্য করতে পারছে না। তার মতে, এখানে কোনো ভবিষ্যৎ নেই—নেই জীবন, কাজ বা শিক্ষা। তাই, যারা যেতে চায়, তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা।