কর্মজীবনের এই শব্দগুলো: বিরক্তিকর নাকি জরুরি?

কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিছু বিশেষ শব্দ বা পরিভাষা, যা অনেক সময় কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে, তাদের কাজকে কঠিন করে তোলে, এমনকি এক ধরনের মানসিক চাপেরও সৃষ্টি করে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কর্মীদের ওপর করা এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫৮ শতাংশ কর্মী মনে করেন তাদের সহকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে এইসব জটিল শব্দ ব্যবহার করেন।

এই ধরনের শব্দ ব্যবহারের কারণে অনেক সময় কাজের গতি কমে যায় এবং উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়। কিন্তু এই ধরনের শব্দ ব্যবহার সত্ত্বেও, আমরা প্রায়ই এদের ব্যবহার করতে দেখি।

কর্পোরেট জগতে, এইসব শব্দ ব্যবহারের কারণ কি? কেন আমরা এখনো এর ব্যবহার করি?

ভাষা কেবল তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম নয়, বরং এটি সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে। ভাষাবিজ্ঞানী ডারিয়া বাখতিনার মতে, যখন আমরা কথা বলি, তখন আমরা শুধু তথ্য বিনিময় করি না, বরং এর মাধ্যমে নিজেদের পরিচয়, সম্পর্ক এবং অবস্থানও প্রকাশ করি।

কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত এইসব শব্দ আসলে একটি দলের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা থেকে আসে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং দলের নিজস্ব পরিভাষা থাকতে পারে, অথবা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মীরাও বিশেষ কিছু শব্দ ব্যবহার করতে পারেন।

বিগত কয়েক দশকে কর্মক্ষেত্রে ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে। একসময়, উৎপাদনশীলতা এবং নির্ভুলতাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, বিশেষ করে চতুর্থ প্রজন্মের নারী আন্দোলন এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে, কর্মক্ষেত্রে ‘ডিইআই’ (DEI – Diversity, Equity, and Inclusion), ‘আনকনসাস বায়াস’ (Unconscious Bias) এবং ‘ইনক্লুসিভ লিডারশিপ’-এর মতো শব্দগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

এমনকি, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ‘কুইট কুইটিং’ (Quiet Quitting) এবং ‘কফি ব্যাজিং’ (Coffee Badging)-এর মতো শব্দগুলোও আলোচনায় এসেছে, যা কর্মীদের কাজের নতুন সংজ্ঞা এবং কর্মপরিবেশকে নির্দেশ করে।

কিন্তু এই ধরনের শব্দ ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অনেক সময়, এই বিশেষ শব্দগুলো একটি দলের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। কিছু মানুষ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে নিজেদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয়, যা অন্যদের কাছে দুর্বোধ্য হতে পারে।

এর ফলে যারা এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত নয়, তারা নিজেদের কর্মপরিবেশে কিছুটা কোণঠাসা অনুভব করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক সময় জটিল পরিস্থিতি বা কঠিন বিষয়গুলো আড়াল করারও চেষ্টা করা হয়। যেমন, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় ‘সিন্থেটিক সিডিও’ (Synthetic CDOs) এবং ‘ট্রাঞ্চেস অফ ডেট প্রোডাক্টস’ (Tranches of Debt Products)-এর মতো শব্দ ব্যবহার করে ঝুঁকির পরিমাণ গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

এছাড়াও, কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো বিষয়গুলোকেও ‘পুনর্গঠন’ বা ‘পুনরায় বিন্যাস’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করে হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এরিক অ্যানিচিচ-এর মতে, কর্মক্ষেত্রে কিছু মানুষ এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিতে চান। তার মতে, “jargon অনেকটা বিলাসবহুল গাড়ির মতো, যার হয়তো কিছু প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে এটি একটি মর্যাদার প্রতীকও বটে।”

তাহলে, এই পরিস্থিতিতে আমাদের কি করা উচিত? আমাদের কি কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলোকে সহজ করে আনা উচিত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব সময় তা করার প্রয়োজন নেই।

বরং, আমাদের দেখতে হবে, এই শব্দগুলো কিভাবে এবং কখন ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভাষা কি কর্মীদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াচ্ছে, নাকি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছে?

এই শব্দগুলো কি মানুষকে আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করছে, নাকি তাদের দূরে রাখছে?

কাজেই, কর্মক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। আমাদের দেখতে হবে, ব্যবহৃত শব্দগুলো কর্মীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে কিনা। যদি তা হয়, তবে সম্ভবত কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগের ধরন পরিবর্তনের সময় এসেছে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *