বিখ্যাত খেলাধুলার জুতো প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হোকা (Hoka)-এর বিরুদ্ধে মাওরি সংস্কৃতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছে। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী সংস্কৃতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং অধিকারকর্মীরা এই অভিযোগ এনেছেন। তাদের মতে, হোকা তাদের পণ্যের নামকরণ এবং লোগোতে মাওরি শব্দ ব্যবহার করলেও, এর উৎপত্তিস্থল ও সংস্কৃতির প্রতি কোনো সম্মান দেখায়নি। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে ওঠা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিযোগের একটি নতুন উদাহরণ।
হাকা (Hoka) মূলত ফ্রান্স-আমেরিকার একটি কোম্পানি, যারা বিশেষ করে দৌড়ানোর জন্য জুতো তৈরি করে। তাদের নামের উৎপত্তি মাওরি শব্দ ‘হোকা’ থেকে, যার অর্থ ‘উড়ে যাওয়া’। কোম্পানির লোগোতে একটি উড়ন্ত পাখির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা এই নামের তাৎপর্য বহন করে। তাদের মূল শ্লোগানও ছিল ‘ফ্লাই, হিউম্যান, ফ্লাই’— অর্থাৎ, ‘মানুষ, উড়ো’।
শুরুতে, কোম্পানিটি তাদের নামের উৎস হিসেবে ‘প্রাচীন মাওরি ভাষা’-কে উল্লেখ করত। কিন্তু ২০১২ সালে ডেক্কার্স ব্র্যান্ডস (Deckers Brands) কোম্পানিটি হাকার মালিকানা নেওয়ার পর তাদের ওয়েবসাইট থেকে এই উল্লেখটি সরিয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে, কোম্পানির ওয়েবসাইটে নামের উৎস সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
এই বিষয়ে মাওরি সংস্কৃতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবী লিনেল টাফেরি হুরিয়া (Lynell Tuffery Huria) বলেন, “যদি তারা মাওরি শব্দের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে না চায়, তাহলে তাদের এই শব্দ ব্যবহার করা বন্ধ করা উচিত। আপনি যদি কোনো শব্দের উৎপত্তিস্থল এবং ইতিহাসকে স্বীকার না করেন, তাহলে কেন সেই শব্দটি ব্যবহার করবেন? কেন আদিবাসী মানুষের সঙ্গে আলোচনা করবেন না, যাদের থেকে এই শব্দের উৎপত্তি?”
এই প্রসঙ্গে হোকা কর্তৃপক্ষের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাওরি সংস্কৃতিতে শব্দ, ধারণা এবং মোটিফগুলোর গভীর তাৎপর্য রয়েছে এবং এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বা ‘টিকাঙ্গা’ (tikanga) মেনে চলতে হয়। এই নিয়ম না মানলে মাওরি সংস্কৃতির অবমাননা করা হয় এবং ব্র্যান্ডগুলো সমালোচনার শিকার হতে পারে।
গত কয়েক বছরে, বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড মাওরি শব্দ ও চিত্র ব্যবহার করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০২০ সালে, ফর্মুলা ওয়ান চালক ফার্নান্দো আলোনসোর পোশাকের লাইনের বিরুদ্ধে মাওরি সংস্কৃতি থেকে মুনাফা তোলার অভিযোগ উঠেছিল। এক বছর পর, একটি ব্রিটিশ কার্পেট কোম্পানি মাওরি সংস্কৃতি ব্যবহার করে কার্পেট বিক্রি করার জন্য সমালোচিত হয়।
গেমিং কোম্পানিগুলো তাদের চরিত্রে মাওরি ট্যাটু ব্যবহার করার জন্য এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো মাওরি ফেসিয়াল ট্যাটুর ফিল্টার তৈরি করার জন্য সমালোচিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে, এয়ার নিউজিল্যান্ড (Air New Zealand) ‘কিয়া ওরা’ (Kia Ora) অভিবাদন চিহ্নের ট্রেডমার্ক করার চেষ্টা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
একই বছর, একটি ক্রুজ শিপ কোম্পানি তাদের কর্মীদের ভুল মাওরি পোশাক পরিয়ে অতিথিদের অভিবাদন জানানোর জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া, বিয়ার কোম্পানিগুলোও তাদের বোতলে মাওরি পূর্বপুরুষদের ছবি ব্যবহার করার জন্য সমালোচিত হয়েছে।
লিনেল টাফেরি হুরিয়ার মতে, ব্র্যান্ডগুলো মাওরি শব্দ ব্যবহার করতে পারে, যদি তারা সঠিক নিয়ম মেনে চলে। এর মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা অন্যতম। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং গল্পগুলো সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই… তবে এটি অবশ্যই সম্মান ও সুরক্ষার সঙ্গে করতে হবে, যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।”
হোকা-র তৈরি জুতো ‘আরাহি’ (Arahi) এবং ‘হোপারা’ (Hopara)-র নামও মাওরি শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। হোপারা শব্দটি আসলে ‘হোপারা’ (hōpara) হওয়া উচিত, যার অর্থ ‘অনুসন্ধান করা’। ‘আরাহি’ শব্দের অর্থ ‘নেতৃত্ব দেওয়া’। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এই শব্দটি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশেষজ্ঞ কারাইটিয়ানা তাইয়ুরু (Karaitiana Taiuru) বলেন, “পবিত্র কোনো জিনিসকে আপনার পায়ে বা জুতোয় রাখা সংস্কৃতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। এটা খুবই আপত্তিকর।” তিনি আরও যোগ করেন, “এটা অনেকটা আপনার জুতোর নীচে কোনো রাজপরিবারের সদস্যের ছবি রাখার মতো।”
২০১৯ সালে, হোকা-র একটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিওতে একজন মাওরি সঙ্গীতশিল্পীকে মাওরি ভাষা সপ্তাহে ব্র্যান্ডের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে দেখা যায়। কিন্তু কোম্পানির সাম্প্রতিক ভিডিওগুলোতে, হোকা এবং মাওরি নামের জুতোগুলোর ভুল উচ্চারণ করা হয়েছে। তাইয়ুরুর মতে, হোকা-র অন্তত তাদের নিজস্ব নামটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করা উচিত। তিনি বলেন, “এটা না করার মাধ্যমে তারা চরম অসম্মান দেখাচ্ছে।”
তাইয়ুরুর মতে, সংস্কৃতির আত্মীকরণ এবং মূল্যায়নের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। হোকা-র মতো ব্র্যান্ডগুলোর আদিবাসী সংস্কৃতিকে সম্মান জানানোর সর্বোত্তম উপায় হল তাদের সঙ্গে আলোচনা করা। তিনি বলেন, “যদি আপনি অন্য কারো সংস্কৃতি আপনার পণ্যের জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার অন্তত সেই সাংস্কৃতিক উপাদানের মূল্য জানা উচিত এবং তা স্বীকার করতে হবে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান