চীনের বিনিয়োগকারীদের মন জয়ে তৎপর শি জিনপিং, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির চাপ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সম্প্রতি তিনি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে একাধিক বাণিজ্য অংশীদারদের উপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বৈঠকে শি জিনপিং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেন, চীনের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তিনি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য চীনকে “আদর্শ, নিরাপদ এবং প্রতিশ্রুতিশীল গন্তব্য” হিসেবে উল্লেখ করেন। চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা শিনহুয়া’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠকে ফেডেক্স-এর প্রধান নির্বাহী রাজ সুব্রামানিয়াম এবং কোয়ালকমের সিইও ক্রিস্টিয়ানো আমোন সহ চল্লিশ জনের বেশি নির্বাহী অংশ নেন।
শি জিনপিং বাজার প্রবেশাধিকার সহজ করা, বিদেশি ব্যবসার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বিদেশি কোম্পানিগুলো চীনের আমদানি ও রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ এবং দেশটির রাজস্বের এক-সপ্তমাংশ সরবরাহ করে। এছাড়াও, তারা প্রায় তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
বৈঠকে শি জিনপিং বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোকে “যুক্তিসঙ্গতভাবে কথা বলার”, “ব্যবহারিক পদক্ষেপ নেওয়ার” এবং “বৈশ্বিক শিল্প সরবরাহ শৃঙ্খলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করার যেকোনো প্রচেষ্টার” বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি সম্ভবত ট্রাম্পকে ইঙ্গিত করে বলেন, বিদেশি ব্যবসাগুলোর উচিত হবে “বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কোনো পদক্ষেপের অন্ধ অনুকরণ না করা।”
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেইমলার এজি’র ওলা ক্যালেনিয়াস, সানোফি’র প্রধান নির্বাহী পল হাডসন এবং এইচএসবিসি’র প্রধান নির্বাহী নোয়েল কুইন। এছাড়াও, ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটস-এর প্রতিষ্ঠাতা রে ডালিয়ো, বিএমডব্লিউ-এর চেয়ারম্যান অলিভার জিপসে এবং টয়োটা’র চেয়ারপারসন আকিও টয়োদা-ও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত চীন উন্নয়ন ফোরামের পর অনেক বিদেশি নির্বাহী বেইজিংয়ে অবস্থান করছেন। ফোরামে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বিশ্ব অর্থনীতির “অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা” এর মধ্যে “সংরক্ষণবাদের বিরোধিতা” করার আহ্বান জানান। এই ফোরামে প্রতি বছর বহু আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী নেতা অংশ নেন।
এদিকে, চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাওয়ের সঙ্গে বৈঠকে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক চীনের সরবরাহ শৃঙ্খল, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং সামাজিক কল্যাণ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন। বৈঠকে ওয়াং ওয়েনতাও একতরফা মার্কিন শুল্কের সমালোচনা করে বলেন, এটি ব্যবসার কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। তিনি আরও জানান, চীন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
তবে চীনের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে দুর্বল আবাসন খাত, ভোক্তাদের ব্যয় হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতির চাপ। এমন পরিস্থিতিতেও চীন চলতি বছর ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যদিও দেশটির পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে সামনে কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম দুই মাসে চীনে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)-এ ২০ শতাংশ পতন হয়েছে। গত বছর বার্ষিক এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১১৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৬ সালের পর সর্বনিম্ন।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে চীন থেকে বিদেশি ব্যবসা ও পুঁজি সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের নেতৃত্ব বিদেশি বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করছে।
গত মাসে শি জিনপিং চীনের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা, হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেই, বিওয়াইডি-র প্রধান নির্বাহী ওয়াং চুয়ানফু এবং টেনসেন্ট-এর প্রধান নির্বাহী পনি মা-ও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শি জিনপিং বলেন, “এখনই ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তাদের উন্নতি লাভের উপযুক্ত সময়।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য বিরোধ দেখা দেওয়ায় চীনের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ট্রাম্প চীনের সকল পণ্যের উপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যের উপর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে।
এছাড়াও, চীন তার অ্যান্টি-স্যংশন আইনকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই আইনের অধীনে, যে সকল বিদেশি রাষ্ট্র চীনকে “নিরুৎসাহিত করবে” বা চীনা নাগরিক বা সত্তাদের উপর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেবে, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র খুব সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন দেশের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারে। এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং ট্রাম্পের মতে “অন্যায্য বাণিজ্য চর্চা” মোকাবেলা করা। তবে ট্রাম্প বারবারই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি চীনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী।
তথ্য সূত্র: সিএনএন