বন্ধুত্বের এক অন্য সংজ্ঞা: জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনির গভীর সম্পর্ক
সঙ্গীতের ইতিহাসে এমন কিছু বন্ধুত্বের গল্প আছে, যা কেবল দুটি মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। জন লেনন এবং পল ম্যাককার্টনির বন্ধুত্ব তেমনই এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এই দুই কিংবদন্তীর মধ্যে গড়ে ওঠা গভীর সম্পর্ক, যা সঙ্গীতের জগৎকে নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে গিয়েছিল, তা আজও মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে।
১৯৫৭ সালের গ্রীষ্মে, লিভারপুলে, জন লেনন এবং পল ম্যাককার্টনির প্রথম দেখা হয়। জন ছিলেন ১৬ বছরের টগবগে যুবক, আর পল ১৪ বছরের কিশোর। জনের স্কিফল ব্যান্ড ‘দ্য কোয়ারি মেন’-এর একটি অনুষ্ঠানে পল যোগ দেন। গান শেষে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়, এবং খুব দ্রুতই তারা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাদের এই আকর্ষণ নিছক সাধারণ বন্ধুত্বের চেয়ে অনেক গভীর ছিল।
তাদের সম্পর্ক নিবিড় হলেও, শারীরিক সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অন্য সব দিক থেকে, তাদের এই বন্ধুত্ব ছিল যেন এক গভীর প্রেম। তাদের মধ্যে ছিল তীব্র আকর্ষণ, স্নেহ এবং কিছু দুঃখের স্মৃতি। এমন গভীর বন্ধুত্ব পাওয়া যায় খুব কমই, কিন্তু ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যারা শিল্প, সাহিত্য, এবং মানব চিন্তাভাবনার ধারা বদলে দিয়েছে। জন ও পল হয়তো জানতেন না, তারা সেই অসাধারণ সারিরই অংশ।
জন ও পলের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের। পল যখন জনের বাজানো গিটারে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তখন জন পছন্দ করতেন পলের গান লেখার ক্ষমতা এবং সুদর্শন চেহারা। তারা একে অপরের সঙ্গে হাসতেন, মজা করতেন, যা তাদের আরও কাছাকাছি এনেছিল। তারা একসঙ্গে গান লিখতেন, যা তাদের ভেতরের অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ করত। বন্ধুদের চোখেও তাদের সম্পর্ক ছিল বিশেষ—যেন তারা একে অপরের মন পড়তে পারতেন।
তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা বেড়েছিল ব্যক্তিগত দুঃখগুলো ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে। পল-এর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, এবং এর আট মাস পরেই জন-ও হারান তার মাকে, যিনি এক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই শোক তাদের আরও কাছাকাছি এনেছিল। তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক বিশেষ বোঝাপড়া, যা অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করে তুলেছিল।
বিটেলস বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করার পরেও, জন ও পল তাদের বন্ধুত্ব অটুট রেখেছিলেন। তবে তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না। জনের অস্থিরচিত্ততা এবং পল-এর আত্মবিশ্বাসী মনোভাবের কারণে তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে মতবিরোধ হতো। তাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এমনকি, তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও যখন তারা অন্য সঙ্গীর সন্ধান করেন, তখন তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক আরও কঠিন হয়ে যায়।
১৯৭০-এর দশকে, তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়। যদিও তারা মাঝে মাঝে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার বার্তা বিনিময় করেছেন এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আগের সেই ঘনিষ্ঠতা হয়তো আর ফিরে আসেনি।
জন ও পলের এই বন্ধুত্বকে হয়তো কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। তারা ছিলেন বন্ধু, “ভাই”, প্রতিযোগী, এবং শত্রু—সবকিছু ছাড়িয়ে যেন আরও কিছু। তাদের এই সম্পর্কের গভীরতা, তাৎপর্য, এবং সৃষ্টিশীলতা সঙ্গীত জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি ছিল ভালোবাসাপূর্ণ, তীব্র, এবং বিস্ফোরক এক সম্পর্ক, যা আমাদের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
তাদের বন্ধুত্বের মতো গভীর সম্পর্ক যুগে যুগে অনেক শিল্পী এবং চিন্তাবিদের মধ্যে দেখা গেছে। যেমন—উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, ড্যানিয়েল কানম্যান ও অ্যামোস টিভারস্কি। এই সম্পর্কগুলো কেবল বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু ছিল, যা সংস্কৃতি এবং সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান