মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সম্ভবনা: কৌতূহল অভিযান থেকে পাওয়া গেলো নতুন জৈব অণুর সন্ধান।
মহাকাশ গবেষণায় নাসা (NASA)-র কৌতূহল অভিযান (Curiosity rover) আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের সাক্ষী। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তারা মঙ্গল গ্রহের প্রাচীন শিলা থেকে সবচেয়ে বড় আকারের জৈব অণুর সন্ধান পেয়েছেন। এই আবিষ্কার লাল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আরও জোরালো করে তুলেছে।
এই আবিষ্কারের কেন্দ্রবিন্দু হলো প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের একটি শিলার নমুনা, যা ‘গেল ক্রেটার’ (Gale Crater)-এ পাওয়া গেছে। কৌতূহল রোভারের ‘স্যাম্পল অ্যানালাইসিস অ্যাট মার্স’ (SAM) নামক যন্ত্রের মাধ্যমে এই শিলার বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্লেষণে ডেকেন (decane), আন্ডেকেন (undecane) এবং ডোডেকেন (dodecane)-এর মতো জটিল জৈব অণুর সন্ধান মিলেছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই অণুগুলো ফ্যাট অ্যাসিডের অংশ হতে পারে, যা পৃথিবীতে প্রাণের জন্য অপরিহার্য উপাদান এবং কোষের ঝিল্লি তৈরিতে সাহায্য করে। তবে, জীবন না থাকলেও এই ধরনের যৌগ তৈরি হতে পারে, যেমন – জল যখন আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি খনিজ পদার্থের সঙ্গে মিশে।
এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা আরও উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। কারণ, এর মাধ্যমে ধারণা করা হচ্ছে, মঙ্গলে যদি কোনো এক সময় প্রাণের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তবে সেই সম্পর্কিত চিহ্নগুলো এখনো সেখানে বিদ্যমান থাকতে পারে। যদিও সৌর বিকিরণের কারণে সেই চিহ্নগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও এই আবিষ্কার সেই সম্ভবনাকে টিকিয়ে রেখেছে।
ফরাসি ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের বিজ্ঞানী ড. ক্যারোলিন ফ্রেইসিনেট (Dr. Caroline Freissinet) এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “যদি মঙ্গলে কোনো এক সময় প্রাণের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে সেই জীবনের কিছু জটিল এবং দুর্বল অণু নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আমরা এখন জানি যে মঙ্গল গ্রহে এই জটিল এবং দুর্বল অণুগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব। এর মানে হলো, আমরা হয়তো মঙ্গলে প্রাচীন জীবনের সন্ধান পেতে পারি।”
২০১২ সালে কৌতূহল রোভার গেল ক্রেটারে অবতরণ করে এবং এরপর থেকে এটি বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়েছে। এর মধ্যে ইয়োলোনাইফ বে (Yellowknife Bay) অঞ্চলের শিলা উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রাচীন একটি হ্রদের অস্তিত্ব ছিল।
কৌতূহল রোভারের বিজ্ঞানীরা এই স্থান থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন, সেখানে কাদামাটির মধ্যে জৈব অণুগুলো জমা ছিল।
এই আবিষ্কারের ফলে ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহ থেকে নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পৃথিবীর অত্যাধুনিক গবেষণাগারে এই নমুনাগুলি পরীক্ষা করে, তারা প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে পারবেন।
বর্তমানে, কৌতূহল রোভার ইয়োলোনাইফ বে-র নমুনাগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা এই নমুনাগুলো নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করছেন, যা সম্ভবত আমাদের এই অনুসন্ধানে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আবিষ্কার সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি, যা মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করেছে। পার্ডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বেন কে. ডি. পিয়ার্স (Dr. Ben K.D. Pearce)-এর মতে, “এই আবিষ্কার সম্ভবত মঙ্গলে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জৈব অণুর সন্ধান।”
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (European Space Agency) ২০২৮ সালে ‘এক্সোমার্স রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন’ (ExoMars Rosalind Franklin) নামক একটি রোভার পাঠাবে, যার সঙ্গে স্যাম (SAM)-এর মতো একটি যন্ত্র থাকবে। এই রোভার মঙ্গলের পৃষ্ঠের ২ মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করতে সক্ষম হবে এবং সম্ভবত আরও বড় আকারের জৈব অণুর সন্ধান করতে পারবে।
নাসার বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আবিষ্কারগুলি মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও এই অণুগুলির উৎস সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে ভবিষ্যতে নমুনাগুলি পৃথিবীতে এনে আরও বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
তথ্য সূত্র: CNN