ছোটবেলার স্মৃতি: সত্যিই কি শিশুরা কিছু মনে রাখতে পারে?

শিশুকালের স্মৃতি: শৈশবের দিনগুলো কি আসলেই মনে থাকে?

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো কি সত্যিই আমাদের মনে থাকে? নাকি সময়ের সাথে সাথে সেগুলো ধুলোর মতো মিলিয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এক দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন.

মানুষের শৈশবের স্মৃতি, বিশেষ করে জীবনের প্রথম কয়েক বছরের স্মৃতিগুলো কেন এত সহজে মনে থাকে না, সেই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।

সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, শিশুদের মস্তিষ্ক আসলে স্মৃতি তৈরি করতে সক্ষম, তবে সেই স্মৃতিগুলো দীর্ঘকাল ধরে মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নতুন একটি গবেষণায় শিশুদের স্মৃতিশক্তি নিয়ে নতুন তথ্য উঠে এসেছে। *সায়েন্স* জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক অংশটি স্মৃতি তৈরি করতে সক্রিয় হয়।

হিপোক্যাম্পাস হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গবেষকরা শিশুদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে শিশুদের জেগে থাকা অবস্থায় মুখ ও বিভিন্ন বস্তুর ছবি দেখানোর সময় তাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়।

গবেষকরা দেখেছেন, কোনো ছবি প্রথমবার দেখার সময় শিশুর হিপোক্যাম্পাস বেশি সক্রিয় থাকলে, সেই ছবিটি কিছুক্ষণ পর আবার দেখালে তারা সেটির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।

এর থেকে বোঝা যায়, শিশুরা তাদের চারপাশের জগৎ থেকে পাওয়া তথ্য মনে রাখতে পারে।

এই গবেষণার প্রধান লেখক, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ড. ট্রিস্তান ইয়েটস বলেন, “আমাদের গবেষণা প্রমাণ করে যে শিশুদের স্মৃতি তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে। তবে, এই স্মৃতিগুলো কত দিন স্থায়ী হয়, তা এখনো একটি বড় প্রশ্ন।”

আগে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, শৈশবের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কের অপরিণত অবস্থার কারণে তৈরি হয় না।

কিন্তু নতুন এই গবেষণা সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শৈশবের স্মৃতিগুলো তৈরি হলেও, সেগুলো হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে যায়।

শিশুদের মস্তিষ্কে দ্রুত নতুন নিউরনের সৃষ্টি হয়, যা বিদ্যমান স্মৃতিগুলোকে হয়তো “মুছে দেয়” বা দুর্বল করে দেয়।

এছাড়াও, স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শৈশবে স্মৃতিগুলোকে গুছিয়ে রাখার মতো ভাষা এবং আত্ম-সচেতনতার অভাবও স্মৃতি দুর্বল হওয়ার কারণ হতে পারে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, শৈশবের স্মৃতিগুলো ভুলে যাওয়া হয়তো বিকাশের একটি অংশ।

এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক সাধারণ জ্ঞান অর্জনের ওপর বেশি মনোযোগ দিতে পারে, যা শিশুদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে।

অনেকেই দাবি করেন যে, তারা ছোটবেলার কিছু ঘটনা মনে করতে পারেন।

তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো সম্ভবত ‘সোর্স মিসএট্রিবিউশন’-এর ফল।

অর্থাৎ, কোনো ঘটনার উৎস সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকে এমনটা হতে পারে।

যেমন, প্রথমবার চুল কাটার সময় কান্নার কথা মনে আছে, কিন্তু সেই ঘটনার সঠিক উৎস হয়তো কোনো ছবি বা পরিবারের গল্প।

ভবিষ্যতে, বিজ্ঞানীরা শিশুদের স্মৃতি কত দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে, তা জানার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর জন্য তারা শিশুদের ভিডিও দেখাচ্ছেন এবং তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছেন।

ইয়েটস মনে করেন, “আমাদের শৈশবের কিছু স্মৃতি যে এখনো আমাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান থাকতে পারে, এটি খুবই আকর্ষণীয়।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শৈশবের স্মৃতিগুলো হয়তো পুরোপুরি মুছে যায় না, বরং সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে অন্যভাবে লুকিয়ে থাকে।

হয়তো ভবিষ্যতে কোনো বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই স্মৃতিগুলো আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *