মায়ানমারে ভূমিকম্প: ধ্বংসস্তূপে মুসলিম, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা!

মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে ৭.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর মৃতের সংখ্যা ১,৬০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের সময় মুসলমানরা যখন পবিত্র রমজান মাসে নামাজে মশগুল ছিলেন, তখন অনেক মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এতে বহু মুসল্লির হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, দেশটির বিভিন্ন স্থানে ৫০টির বেশি মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

মান্দালয় অঞ্চলের হতভাগ্য বাসিন্দা হেত মিন উ জানান, তিনি রমজান মাসের নামাজের আগে অজুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় তার বাড়ির কাছে থাকা মসজিদের একটি অংশ ধসে পড়ে।

এতে তার বাড়িটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে তার দুই মাসি। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধারের জন্য ছুটে আসে, তবে তাদের মধ্যে একজন বাদে সবাই মারা যান।

২৫ বছর বয়সী হেত রয়টার্সকে জানান, তার দুই চাচা এবং ঠাকুরমাও কংক্রিটের স্তূপের নিচে আটকা পড়েছিলেন। ভারী সরঞ্জাম না থাকায় তিনি হাত দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি জানি না তারা এখনো বেঁচে আছে কিনা। এত সময় পার হয়ে গেছে, তাদের আর জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। উদ্ধারকর্মীরাও এখনো এসে পৌঁছায়নি।

মান্দালয় অঞ্চলের ৩৯ বছর বয়সী এক বাসিন্দা সুলে কোন গ্রামের একটি মসজিদে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া এক ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন। শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে তাকেও সেখান থেকে পালাতে হয়।

তিনি জানান, “আমি তাকে সেখানে ফেলেই আসতে বাধ্য হয়েছি। পরে, আমি দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়ে আরও চারজনকে উদ্ধার করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের মধ্যে তিনজন ততক্ষণে মারা গিয়েছিল, আর একজন আমার কোলে মারা যায়।

ওই বাসিন্দা আরও জানান, সেখানে ১০ জন নিহত হয়েছেন এবং গ্রামের তিনটি মসজিদে নিহত ২৩ জনের মধ্যে তারা ছিলেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের বিধিনিষেধের কারণে মসজিদগুলোর সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।

মিয়ানমারে মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। দেশটির বিভিন্ন সরকার তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এমনকি দেশটির কট্টরপন্থী সংগঠনগুলোও মুসলিমদের ওপর সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাদের ওপর চালানো হয়েছে গণহত্যা, যার ফলশ্রুতিতে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সরকার মুসলিমদের মসজিদ সংস্কার বা নির্মাণের অনুমতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে গড়িমসি করেছে। ফলে পুরনো মসজিদগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জুলিয়ান কাইল নামের এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কংক্রিটের স্তম্ভ সরানোর জন্য ভারী যন্ত্রপাতির আবেদন জানিয়েছেন। ভূমিকম্পে মান্দালয়ের আরেকটি মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেলে তার পরিবারের সদস্যরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। তিনি জানান, “আমরা তাদের মৃতদেহগুলো উদ্ধারের জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

তাউংনুর এক বাসিন্দা জানান, তিনি কান্দাও মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় মসজিদের এক পাশ ধসে পড়ে, যেখানে তার সামনের সারিতে অনেক মুসল্লি বসেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি অনেক মানুষকে মসজিদের ভেতর থেকে বের করতে দেখেছি। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার চোখের সামনেই মারা যান। যা ছিল খুবই হৃদয়বিদারক।

আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার মসজিদ ধসের ঘটনায় আরও অনেক পুরনো ভবন, বিশেষ করে ১৫০ বছরের পুরনো ভবনগুলোর ওপর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ, সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সেগুলোর সংস্কার করা হয়নি।

সামরিক সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৬৭০টি মঠ এবং ২৯০টি প্যাগোডার ক্ষতি হয়েছে। তবে তারা তাদের ক্ষতিগ্রস্থের তালিকায় কোনো মসজিদের কথা উল্লেখ করেনি।

ভূমিকম্পের কারণে এরই মধ্যে মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি, সেতু ও রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বিপর্যয়ের আসল চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকক-ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক হ্যারি রবার্টস বলেছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্ভবত “খুব জটিল” এবং “গুরুতর”। কারণ, দেশটির সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য চেয়েছে।

রবার্টস আরও বলেন, “সরকারের এই অনুরোধের ফলস্বরূপ অভিবাসন ও কাস্টমসেও পরিবর্তন আসতে পারে, যাতে আমাদের মতো এনজিওগুলো দ্রুত সাহায্য পাঠাতে পারে। বর্তমানে, আমরা তথ্য সংগ্রহ এবং দেশটিতে প্রবেশের উপায় খুঁজছি।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *