ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ভূমি দখলের নতুন চিত্র: বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকলেও, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েল দ্রুত তাদের ভূখণ্ডের মানচিত্র পরিবর্তন করছে। সেখানকার ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে।
গত কয়েক মাসে, বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে, ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে তাদের আগ্রাসন আরও বাড়িয়েছে। বুলডোজার দিয়ে একের পর এক ফিলিস্তিনি বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার অনুসন্ধানী বিভাগ সানাদের তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র এবং মানচিত্র ব্যবহার করে এই পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
জানা গেছে, শুধু গত কয়েক মাসে ৪০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় ইনতিফাদার পর প্রথমবারের মতো, ইসরায়েলি বাহিনী ট্যাঙ্ক ও বিমান হামলা পুনরায় শুরু করেছে।
মূলত পশ্চিম তীরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্যই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম তীর, যা আরবিতে “আল-দাফ্ফাহ” নামে পরিচিত, জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটি অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমসহ প্রায় ৫,৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
এটি গাজার চেয়ে ১৫ গুণ বড়, যা যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার রাজ্যের সমান।
১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল এই এলাকাটি সামরিকভাবে দখল করে রেখেছে। সেখানকার ফিলিস্তিনিরা নিয়মিতভাবে চেকপোস্ট, নির্বিচারে গ্রেফতার, ঘরবাড়ি ধ্বংস, ভূমি দখল, বসতি স্থাপন এবং প্রায়শই হামলার শিকার হচ্ছেন।
ফলে তাদের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৩৩ লক্ষ ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীরে বসবাস করেন।
এখানকার প্রধান শহরগুলোর মধ্যে হেবরন বা আল-খলিল সবচেয়ে জনবহুল, যেখানে প্রায় ৮ লক্ষ ৪২ হাজার মানুষের বসবাস। এরপর জেরুজালেমে ৫ লক্ষ, নাবলুসে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার, রামাল্লা ও এল-বিরেতে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার এবং জেনিনে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ বাস করেন।
অন্যদিকে, প্রায় ৭ লক্ষ ইসরায়েলি অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে বসবাস করে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৮৯৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
শুধু ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবরের মধ্যে, আল-আকসা প্লাবন অভিযানের কয়েক ঘণ্টা আগে, মৃতের সংখ্যা ছিল ১৯৮, যা ২০২২ সালের ১৫৪ জনের তুলনায় অনেক বেশি।
গত ১৭ মাসে, পশ্চিম তীরে ৯০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের অর্ধেকের বেশি জেনিন ও তুলকারেম এলাকার বাসিন্দা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই সহিংসতাকে “বর্বর” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, যা তারা “অপারেশন আয়রন ওয়াল” নামে চালাচ্ছে, মূলত জেনিন ও তুলকারেম অঞ্চলের দিকে বেশি কেন্দ্রীভূত। এই দুটি অঞ্চলে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম এবং এখানে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের কেন্দ্র ছিল।
এর প্রতিক্রিয়ায়, ইসরায়েল এই অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যা প্রতিরোধের কণ্ঠ স্তব্ধ করে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার একটি কৌশল।
বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে, তুলকারেম শরণার্থী শিবিরে ২০৫টি ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন এবং কৃষি অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে।
এরপর নূর শামস শিবিরে ১৭৪টি এবং জেনিন শিবিরে ১৪৪টি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের একটি এনজিও, পিস নাও-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে পশ্চিম তীরে রেকর্ড সংখ্যক ৪৮টি নতুন বসতি স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধের আগে, বসতি স্থাপনের গতি আরও দ্রুত ছিল।
২০২৩ সালেই ৩১টি নতুন বসতি স্থাপন করা হয়েছিল।
বসতি স্থাপনকারীদের হামলাও এখন একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়, যার ফলে জরুরি পরিষেবা ও জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
অনেক ক্ষেত্রে তারা পানির উৎসও ধ্বংস করে দেয়, যা ফিলিস্তিনি পশুচারণ সম্প্রদায়ের জন্য অপরিহার্য।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা ইয়েস দিন-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা সম্পর্কিত ১,৬৬৪টি পুলিশি তদন্তের মধ্যে দুর্বলতা ছিল।
মানবাধিকার সংস্থা বি’সেলেমের মতে, বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার জন্য ইসরায়েলের একটি “বেসরকারি হাতিয়ার” হিসেবে কাজ করছে।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা হামোকেদের জুন ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েল দ্রুত পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে, যা পূর্ণাঙ্গ দখলের দিকে একটি পদক্ষেপ।
এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ। তিনি সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি নতুন পদ লাভ করেছেন, যার মাধ্যমে পশ্চিম তীরে বেসামরিক বিষয়ে তার ব্যাপক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্মোট্রিচ, যিনি অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত কেডুমিন বসতির বাইরে ফিলিস্তিনি ভূমিতে বসবাস করেন, তিনি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ, সেটেলমেন্ট প্রশাসনেরও প্রধান। এই প্রশাসন ইসরায়েলি বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণের তদারকি করে থাকে।
২০২৪ সালে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ২৪,৭০০ ডুনাম (৬,১০০ একর বা ২,৪৭০ হেক্টর) ভূমিকে “রাষ্ট্রীয় ভূমি” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, যা ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সংযুক্ত ২৩,০০০ ডুনামের চেয়ে বেশি।
এছাড়াও, ৬৮টি অবৈধ বসতিকে ইসরায়েল স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেখানে অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ আরও গভীর করেছে।
স্মোট্রিচের ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ দ্রুত বাড়ছে। তার প্রশাসন বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে মিলে ভূমি দখল, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং অবৈধ বসতিগুলোকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, যা বসতি স্থাপনকে আরও শক্তিশালী করছে।
তুলকারেম ও জেনিনের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে বুলডোজার দিয়ে অন্তত ৫২৩টি ভবন ধ্বংস করা হয়েছে, যার ফলে কয়েক হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) মতে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীরে এটি ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় আকারের বাস্তুচ্যুতি।
বর্তমানে ৪০,০০০ এর বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
জেনিন, তুলকারেম ও নূর শামসে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্রগুলো সেখানকার ফিলিস্তিনি সমাজের ওপর ইসরায়েলের পদ্ধতিগত আক্রমণের প্রমাণ।
জেনিনে ১৪টি মাটির ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে এবং এর কাছে সামরিক যান মোতায়েন করা হয়েছে।
এছাড়াও, অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। নভেম্বরে, ৭৯৩টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল, যার ৬০ শতাংশ হেবরন, নাবলুস ও রামাল্লায় অবস্থিত।
এর ফলে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে, বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
বসতি স্থাপন দ্রুত বাড়লেও, ইসরায়েল একটি জনমিতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কারণ পশ্চিম তীর, গাজা ও ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের জন্মহার ইসরায়েলিদের তুলনায় বেশি।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, ইসরায়েল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা কমানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তারা বাস্তুচ্যুতিকে নিরাপত্তা ও “মানবিক” সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও এই কৌশল স্পষ্ট। মার্চ ২০২৫-এ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ইয়োভ কাটস, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতিগুলোকে “ইসরায়েলি শহর রক্ষার জন্য অপরিহার্য” বলে বর্ণনা করেছেন।
অন্যদিকে, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গিডিয়ন ডোকভ ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নকে “একমাত্র মানবিক সমাধান” হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ফিলিস্তিনিদের “খুনি জাতি” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
“ফাইটিং ফর লাইফ” নামক একটি প্রচারণায় “ফিলিস্তিনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই” স্লোগান ব্যবহার করা হচ্ছে, যা “স্বেচ্ছায় অভিবাসন”-কে উৎসাহিত করছে।
অন্যদিকে, জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাজনীতির অধ্যাপক মেইর মাসরি সামাজিক মাধ্যম এক্সে লিখেছেন যে, পশ্চিম তীরের দখল “১৯৬৭ সালের পর সবচেয়ে বড় জায়নবাদী অর্জন”।
তিনি এটিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা হাতছাড়া করা উচিত নয়।
তবে, ইসরায়েলি ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ (আইএনএসএস) প্রকাশিত একটি নীতিপত্রে সতর্ক করা হয়েছে যে, একতরফাভাবে এই দখলের ফলে ইসরায়েল বিশ্বজুড়ে আরও একঘরে হয়ে পড়বে এবং ইহুদিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা