মহাকাশ বিজয়ের অগ্রদূত: স্বপ্ন আর বাস্তবতার গল্প
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, মানুষ আকাশের সীমা অতিক্রম করে মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু সাহসী মানুষ, যাদের মধ্যে কেউ ছিলেন বিজ্ঞানী, কেউ প্রকৌশলী, আবার কেউ ছিলেন উদ্যোক্তা।
তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবেই আজ আমরা মহাকাশ ভ্রমণের এত কাছাকাছি পৌঁছেছি।
এই অগ্রদূতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জার্মান প্রকৌশলী লুৎজ কাইজার। তাঁর চোখে ছিল মহাকাশ ভ্রমণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য মহাকাশে যাওয়া সহজলভ্য হোক।
সেই লক্ষ্য নিয়ে তিনি তৈরি করেন ওট্র্যাগ (OTRAG) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওট্র্যাগ-এর মূল ধারণা ছিল, সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করে সহজে তৈরি করা যায় এমন রকেট তৈরি করা।
এই উদ্দেশ্যে, জার্মানির বাইরে, প্রথমে জায়ারে (বর্তমান কঙ্গো) এবং পরে লিবিয়ার মরুভূমিতে ওট্র্যাগ তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যদিও বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে ওট্র্যাগ-এর সেই স্বপ্ন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কিন্তু মহাকাশ প্রযুক্তি গবেষণায় তাদের উদ্ভাবনী ধারণা আজও গুরুত্বপূর্ণ।
মহাকাশযাত্রার ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পেছনে আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি হলেন রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্টান্টিন সিয়লকোভস্কি। তিনি ছিলেন একজন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী, যিনি রকেট বিজ্ঞান এবং মহাকাশ ভ্রমণের গাণিতিক ভিত্তি স্থাপন করেন।
১৮৯৫ সালে তিনি “স্পেস এলিভেটর”-এর ধারণা দেন, যা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ একদিন মহাকাশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে।
অন্যদিকে, আমেরিকান প্রকৌশলী রবার্ট এইচ. গডার্ড তরল-জ্বালানিযুক্ত রকেট তৈরি করে ১৯২৬ সালে প্রথম তা উৎক্ষেপণ করেন। গডার্ডের এই উদ্ভাবন ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা আধুনিক রকেট প্রযুক্তির পথ খুলে দেয়।
যদিও তাঁর সময়ে অনেকে তাঁর কাজের সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর গবেষণাই মহাকাশ বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে।
পরবর্তীতে, বার্ট রুটার-এর মতো ব্যক্তিরা মহাকাশ ভ্রমণের বাণিজ্যিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ডিজাইন করা স্পেসশিপ ওয়ান (SpaceShipOne) ২০০৪ সালে প্রথম বেসরকারি মহাকাশযান হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করে।
রিচার্ড ব্র্যানসনের কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাকটিক (Virgin Galactic) বর্তমানে পর্যটকদের জন্য মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ তৈরি করছে। যদিও এই ভ্রমণের খরচ এখনো অনেক বেশি, তবে এটি মহাকাশ ভ্রমণের ধারণাকে আরও জনপ্রিয় করেছে।
তবে, প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, এই পথ সহজ ছিল না। এলন মাস্কের স্পেসএক্স (SpaceX) এবং জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন (Blue Origin) -এর মতো কোম্পানিগুলো মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চাইছে।
তাঁদের লক্ষ্য হলো, মানুষকে চাঁদে এবং তার বাইরে বসবাস করার সুযোগ তৈরি করা।
মহাকাশ বিজয়ের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়, লুৎজ কাইজার, কনস্টান্টিন সিয়লকোভস্কি, রবার্ট গডার্ড, বার্ট রুটার-এর মতো স্বপ্নদ্রষ্টাদের অবদান অনস্বীকার্য।
তাঁদের উদ্ভাবনী চিন্তা, কঠোর পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলেই আজ আমরা মহাকাশ ভ্রমণের এত কাছাকাছি এসেছি। তাঁদের স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে, মানুষ একদিন সত্যি সত্যিই মহাকাশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা