ফিলিস্তিনের ভূমি দিবসে বাস্তুহারাদের কান্না, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ!

ফিলিস্তিনের ভূমি দিবস, প্রতি বছর ৩০শে মার্চ তারিখে পালিত হয়, যা ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের জমির অধিকারের জন্য সংগ্রামের স্মারক। এই দিনে গাজা শহরের শুজাইয়া এলাকার এক বাসিন্দার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হলো, যিনি এই ভূমি দিবসের আসল অর্থ উপলব্ধি করেছেন বাস্তুচ্যুতি আর ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে।

শৈশবে, ওই এলাকার শিশুরা স্কুলে একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি উৎসর্গীকৃত গান গাইত, যা তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গভীরতা সম্পর্কে শিক্ষা দিত। তাদের কাছে ভূমি দিবস ছিল একটি বিশেষ দিন, যেদিন তারা ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন করত আর তাদের ভূমি রক্ষার সংগ্রামকে স্মরণ করত।

কিন্তু নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে, যখন নিজের জমি হারানোর সম্ভবনা দেখা দেয়, তখনই যেন এই সংগ্রামের আসল অর্থ উপলব্ধি হয়।

গাজা শহরের পূর্বে অবস্থিত শুজাইয়া এলাকা, যেখানে ওই ব্যক্তির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এটি শত শত বছরের পুরনো একটি এলাকা, যেখানে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বসবাস করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি গাজার অন্যতম জনবহুল এলাকায় পরিণত হয়, যা তার শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন এবং প্রতিরোধের ইতিহাসের জন্য পরিচিত।

সেখানকার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. রিফাত আল-আরের, যিনি ছিলেন একাধারে কবি, পণ্ডিত এবং ওই ব্যক্তির ইংরেজি শিক্ষক। তিনিই ছিলেন তাকে লিখতে ও প্রতিরোধের জন্য অনুপ্রাণিত করা এক মহান শিক্ষক।

তাদের পরিবার শত শত বছর ধরে শুজাইয়াতে বসবাস করে আসছে। তারা একই এলাকায় একের পর এক বাড়ি তৈরি করেছে, যা মুশতাহা স্ট্রিট নামে পরিচিত। এই নাম তাদের ভূমির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের প্রমাণ।

তাদের বাড়িগুলোর পাশাপাশি, শুজাইয়াতে তাদের নিজস্ব কৃষি জমি ছিল। লেখকের শৈশব কেটেছে দাদার জলপাই বাগানে, যা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। জলপাই গাছগুলো তাদের শিখিয়েছিল কীভাবে তাদের ভূমিকে ভালোবাসতে হয়, আর তাদের মতোই অবিচল থাকতে হয়।

নিজের জন্মভূমি, নিজের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা লেখক কখনোই এক মুহূর্তের জন্য ভাবেননি। শৈশবে তিনি অন্য কোথাও বসবাসের স্বপ্ন দেখেননি, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো এখানে থাকতে, জমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে এবং জলপাই গাছের যত্ন নিতে।

২০১৪ সালে ইসরায়েলি হামলার কারণে প্রথমবার তাদের শুজাইয়া ছাড়তে হয়। সেই সময় তিনি ছোট ছিলেন, কিন্তু সেই সময়কার প্রতিটি মুহূর্ত তার মনে আছে। ক্ষেপণাস্ত্র ও ধ্বংসাবশেষের মাঝে তাদের পালিয়ে যাওয়া, চিৎকার আর কান্নার শব্দ—সবকিছুই ছিল এক গভীর ট্রমা।

তবে সেই সময়েও তিনি বিশ্বাস করতেন যে তারা শীঘ্রই ফিরে আসতে পারবেন।

প্রায় ১০ বছর পর, আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। গাজায় চলমান সংঘাতের সময়, তাদের পরিবারকে ১০ বারের বেশি বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে এলাকা থেকে দূরে ছিল, কিন্তু কখনোই গাজার উত্তর ছাড়েননি।

শুজাইয়া এই যুদ্ধে দুটি বড় ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছে—প্রথমটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, এবং দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের জুনে। দ্বিতীয় আক্রমণটি হয় অপ্রত্যাশিতভাবে, যখন বাসিন্দারা তাদের বাড়িতেই ছিলেন।

যখন ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো শুজাইয়াতে প্রবেশ করে, তখন তারা বাজার, পুরোনো রেস্টুরেন্ট, বিদ্যুতের খুঁটি এবং পানির পাম্পগুলোকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

লেখকের পরিবারের বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি তাদের দাদার জমিতে থাকা শতাব্দীর পুরনো জলপাই গাছগুলোও উপড়ে ফেলা হয়।

জলপাই বাগান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লেখকের দাদুর কাছে তা ছিল অসহনীয়। এই খবর শোনার তিন মাসের মধ্যেই তিনি মারা যান।

আজ, তারা আবারও বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। শুজাইয়ার পূর্বাংশের বাসিন্দারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হুমকির মুখে আবারও এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে। তারা জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে।

মানুষ ভীত, কিন্তু তারা এখনও একটি যুদ্ধবিরতির জন্য অপেক্ষা করছে।

এ বছর ভূমি দিবসের তাৎপর্য ভিন্ন। চলমান ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও, তারা এখনও তাদের ভূমিতে টিকে আছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া জমিকে আঁকড়ে ধরে আছে। তারা হাল ছাড়বে না।

এই দিনে, লেখক ড. আল-আরের একটি কবিতার কথা স্মরণ করেন:

“ওহে পৃথিবী,
আমায় জড়িয়ে ধরো
এবং শক্ত করে রাখো,
অথবা গ্রাস করো,
যাতে আর কষ্ট না থাকে।
আমি তোমায় ভালোবাসি,
তাই আমায় নাও।
আমাকে ধনী করো।
আমাকে মাটি করো।
শান্তির দিন চলে গেছে।
বন্দুকই মানবতার ভাষা।
আমার খাবার নেই, শুধু একটি কাঁটা,
খেলা নেই, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস।
কারণ একজন সৈন্যকে উঁচু অনুভব করতে হয়।
ওহে পৃথিবী,
যদি জীবনে কষ্ট পাই,
তবে আমার মাটি তোমাতে জন্ম দিক।
ওহে পৃথিবী।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *