ইরানের নারী অধিকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ কণ্ঠস্বর মাসিহ আলিনেজাদ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে তেহরান সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত, সম্প্রতি এক প্রাণনাশের চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে, সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও, এর ফলস্বরূপ তিনি এখনো গভীর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আদালতে সম্প্রতি দুই রুশ গ্যাংস্টারের বিচার হয়, যাদের বিরুদ্ধে আলিনেজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভাড়া করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আদালত সূত্রে জানা যায়, ইরানের সরকার এই দুই ব্যক্তিকে ব্রুকলিনে আলিনেজাদের বাসভবনে আক্রমণের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে, যার বিনিময়ে তারা ৫ লক্ষ মার্কিন ডলার পাওয়ার কথা ছিল।
আলিনেজাদ দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সরকার এবং দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে নারীদের অধিকার ও হিজাব-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিষয় তুলে ধরতেন এবং পরিবর্তনের আহ্বান জানাতেন। সম্ভবত এ কারণেই ইরানের সরকার তাকে চুপ করাতে চেয়েছিল।
এই ঘটনার পর থেকে আলিনেজাদ কার্যত গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর, ব্রুকলিনে একটি শান্তির আশ্রয় খুঁজেছিলেন তিনি। কিন্তু এই হত্যাচেষ্টার পর সেই আশ্রয়ও যেন তার কাছে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। ঘটনার পর থেকে তিনি এখন পর্যন্ত খুব কমই তার ব্রুকলিনের বাড়িতে গিয়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আত্মগোপন করে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।
আলিনেজাদ বলেন, “সত্যি বলতে, আমি অনেক কেঁদেছি। আমার জীবনটা এখন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি যখন রাস্তায় হাঁটি, তখনও আমাকে সবসময় আশপাশের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। নিজের ভালোবাসার মানুষগুলোর ছবি টাঙানোর মতো একটা বাড়িও আমার নেই, যেখানে আমি নিজের হাতে গাছ লাগাতে পারি।”
ব্রুকলিনে নিজের বাড়ির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, সেখানে তিনি একটি ছোট্ট বাগান তৈরি করেছিলেন, যা তাকে তার গ্রামের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিত। তার বাবা-মা ছিলেন কৃষক এবং তাদের বাগানে নানা ধরনের সবজি ও ফুল গাছ ছিল। তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারের সদস্যদের খুব ভালোবাসি। তাদের কথা ভেবেই আমি ব্রুকলিনে আমার বাগান তৈরি করি।”
আলিনেজাদ মনে করেন, যারা ইরানের শাসকদের সমালোচনা করেন, তাদের জন্য ‘নিরাপদ’ জীবন একটি বিলাসিতা মাত্র। তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন, যখন জানতে পারেন, তুরস্ক থেকে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তাকে সেখানে ডেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এবং এরপর তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করা হবে।
ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে আলিনেজাদ বলেন, “স্বাভাবিক জীবন প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন। আমি শুধু বলতে চাই না যে, আমার স্বাভাবিক জীবন নেই।” তিনি আরও যোগ করেন, “যে নারীকে রাস্তায় চুল দেখানোর ‘অপরাধে’ মারধর করা হয়, হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়, তাদের কি স্বাভাবিক জীবন আছে? আমার মনে হয়, যতদিন ইরানে ইসলামিক রিপাবলিক ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন আমাদের কারোই স্বাভাবিক জীবন থাকবে না।
স্বাভাবিক জীবন তখনই আসবে, যখন ইরানে একটি নিরাপদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।”
আলিনেজাদ মনে করেন, বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের ইরানের আগ্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। তিনি তাদের প্রতি এই হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও অনেক সময় রাজনৈতিক বিভেদ দেখা যায়, কিন্তু বিপদকালে মানুষ একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায়। আলিনেজাদ তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমার প্রতিবেশীরা আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন, কেউ কেউ লাল ওয়াইন দিতেন। এমনকি তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি কোথাও লুকাতে চান, তবে আমার বাড়ি আপনার জন্য নিরাপদ।’”
আলিনেজাদ মনে করেন, রাজনীতিবিদদের এই বিষয়টি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু ভুল আছে। তারা সাধারণ মানুষের মৌলিক বিষয়গুলো ভুলে যান।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান