গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ত্রাণকর্মীদের মরদেহ উদ্ধার, শোকের ছায়া!

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিখোঁজ হওয়া ত্রাণকর্মীদের মরদেহ গণকবরে পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা জানিয়েছে, রাফাহ অঞ্চলের দক্ষিণে একটি স্থান থেকে এক ডজনের বেশি কর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) কর্মীরা জানিয়েছেন, গত ২৩শে মার্চ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় তাদের অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়, এরপর থেকেই ওই কর্মীরা নিখোঁজ ছিলেন।

রবিবার উদ্ধার হওয়া ১৪টি মরদেহের মধ্যে আটজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে, যারা সবাই ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া, পাঁচজন সিভিল ডিফেন্স কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের সংস্থার কর্মচারী ছিলেন।

পিআরসিএস জানিয়েছে, তাদের একজন স্বাস্থ্যকর্মী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। বৃহস্পতিবার আরও একজন সিভিল ডিফেন্স কর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার শুরুতে ওই এলাকায় যেতে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছিল বলেও পিআরসিএস জানায়।

গত সপ্তাহে পিআরসিএস জানিয়েছিল, ২৩শে মার্চ রাফাহর দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় তাদের ৯ জন জরুরি চিকিৎসা কর্মী নিখোঁজ হন। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, হামাস ও ইসলামিক জিহাদ জঙ্গিরা অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার ট্রাক ব্যবহার করছিল এবং সেগুলোর আড়ালে থেকে তারা আক্রমণ চালাচ্ছিল।

তাই তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে।

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, গত এক দশকের মধ্যে এটি তাদের কর্মীদের ওপর হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা।

পিআরসিএস এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের কর্মীদের ওপর এই গণহত্যা শুধু ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জন্য নয়, বরং মানবিক কার্যক্রম এবং মানবতার জন্য একটি ট্র্যাজেডি।” তারা তাদের কর্মীদের ওপর হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক দপ্তর (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, একটি “জটিল উদ্ধার অভিযান”-এর মাধ্যমে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। বুলডোজার ও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বালু খুঁড়ে হতাহতদের এবং তাদের ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িগুলো সেখান থেকে তোলা হয়।

ওচিএ’র প্রধান জোনাথন হুইটেল ঘটনাস্থল থেকে বলেন, “স্বাস্থ্যকর্মীদের কখনো লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। অথচ আজ আমরা এখানে, প্রথম সারির উদ্ধারকর্মী ও প্যারামেডিকদের গণকবর খুঁড়ছি।

ওচিএ’র প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বুলডোজার মাটি খুঁড়ছে এবং ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছে। জরুরি কর্মীরা কোদাল দিয়ে মৃতদেহগুলো বের করছেন। অনেককে পিআরসিএস-এর পোশাক পরা অবস্থায় বালু থেকে তোলা হয় এবং তাদের শরীরে পচন ধরেছিল।

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ২৩শে মার্চ ইসরায়েলি বাহিনী প্রথম দলটিকে হত্যা করে। এরপর, তাদের সহকর্মীদের খুঁজতে যাওয়া অন্যান্য কর্মীদের ওপরও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হামলা চালানো হয়। হুইটেল বলেন, “এক এক করে তাদের ওপর আঘাত হানা হয়েছে, গুলি করা হয়েছে।

তাদের মৃতদেহগুলো সংগ্রহ করে কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায়, হাতে গ্লাভস নিয়েই উদ্ধার করছি।

হুইটেল আরও জানান, অ্যাম্বুলেন্স, জাতিসংঘের গাড়ি এবং সিভিল ডিফেন্সের গাড়িগুলো বালুর নিচে চাপা পড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে আলামত গোপন করার অভিযোগ করেছেন।

পিআরসিএস-এর মতে, তাদের ত্রাণকর্মীরা ২৩শে মার্চ রাফাহর আল-হাশাশিন এলাকায় ইসরায়েলি হামলার শিকার হওয়াদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। এরপরেই তাদের ওপর আক্রমণ হয়।

পিআরসিএস জানায়, “ইসরায়েলি বাহিনী ওই এলাকাটি অবরোধ করে রাখায় আমাদের দলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।”

এর কয়েক ঘণ্টা পর গাজার সিভিল ডিফেন্স জানায়, একই এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর আকস্মিক হামলায় তাদের ছয়জন কর্মীও নিখোঁজ হয়েছেন। হামলায় অনেকে হতাহত হয়েছেন এবং পিআরসিএস-এর গাড়িগুলোও সেখানে অবরুদ্ধ ছিল।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এর আগে জানিয়েছিল, তারা “সন্দেহজনক গাড়িবহর”-এর ওপর গুলি চালিয়েছিল, যার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার ট্রাকও ছিল। ওই গাড়িগুলো আগে থেকে কোনো সমন্বয় না করে এবং হেডলাইট বা জরুরি সংকেত ব্যবহার না করেই সেনাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।

তারা দাবি করে, হামাস ও ইসলামিক জিহাদের জঙ্গিদের নির্মূল করতে তারা ওই গাড়িগুলোতে গুলি চালিয়েছিল। একইসঙ্গে বেসামরিক অবকাঠামো, যেমন চিকিৎসা সুবিধা ও অ্যাম্বুলেন্স, জঙ্গিদের ব্যবহারের জন্য বারবার ব্যবহারেরও নিন্দা জানায় তারা।

এই হামলাগুলো এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইসরায়েল গত ১৮ই মার্চ হামাসের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিয়ে গাজায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৯২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ২ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন।

তবে, স্বাধীনভাবে এই সংখ্যা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। কারণ, ইসরায়েল সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ করতে দেয় না।

এছাড়াও, ইসরায়েল মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের মতে, এর মাধ্যমে হামাসকে যুদ্ধবিরতির শর্ত মানতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়া এবং যুদ্ধকে অস্ত্রের মতো ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। একইসঙ্গে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ত্রাণ বিতরণে বাধা তৈরিরও অভিযোগ করেছে।

আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও মানবিক সংস্থাগুলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিকিৎসা কেন্দ্র ও কর্মীদের ওপর হামলার বারবার নিন্দা জানিয়েছে।

আইএফআরসি-র মহাসচিব জাগান চাপাগাইন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এমনকি সবচেয়ে জটিল সংঘাতপূর্ণ এলাকাতেও কিছু নিয়ম আছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের এই নিয়মগুলো খুবই স্পষ্ট—সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে হবে, মানবিক কর্মীদের রক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা রক্ষা করতে হবে।”

এদিকে, গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭ই অক্টোবর থেকে গাজায় মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে, যা একটি ভয়াবহ মাইলফলক।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *