১৯৮৮ সালের ১১ই জুন, টেলিভিশনের পর্দায় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে আয়োজিত ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা কনসার্ট’ দেখছিলেন ১২ বছর বয়সী জ্যাডি স্মিথ। কনসার্টে গান গাইতে ওঠা অচেনা এক শিল্পীর কণ্ঠে যেন নতুন করে জেগে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা।
শিল্পীটি আর কেউ নন, ট্রেসি চ্যাপম্যান। তাঁর গানগুলো শুধু গানের মতোই শোনেনি স্মিথ, বরং মনে হয়েছে, যেন তাঁদেরই কথা বলছেন তিনি। সম্প্রতি, এই কনসার্ট ও চ্যাপম্যানের প্রথম অ্যালবামের স্মৃতিচারণ করে একটি নিবন্ধ লিখেছেন জ্যাডি স্মিথ, যা আজও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
সেসময়কার প্রেক্ষাপট বিচার করলে, চ্যাপম্যানের উত্থান ছিল রীতিমতো অকল্পনীয়। নব্বই হাজার দর্শকের সামনে, এমনকি টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের ৬০ কোটি মানুষের কাছে একজন অচেনা শিল্পী হিসেবে নিজের পরিচিতি তৈরি করা সহজ ছিল না। কিন্তু ট্রেসি চ্যাপম্যান পেরেছিলেন।
তাঁর কণ্ঠের গভীরতা, গানের কথায় ফুটে ওঠা সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা, দারিদ্র্য, নিপীড়ন—সবকিছুই যেন এক ভিন্ন ধারার জন্ম দিয়েছিল। ‘ফাস্ট কার’ গানের প্রথম লাইন গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠ কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু মুহূর্তেই তিনি সকলের মনোযোগ কেড়ে নেন।
উইলসডেনে (Willesden) বেড়ে ওঠা স্মিথের কাছে চ্যাপম্যান ছিলেন খুবই আপন একজন। সাদামাটা পোশাক, মাথায় সামান্য কয়েক ইঞ্চি লম্বা “ড্রাডলকস” (dreadlocks) চুলের স্টাইল—যেন তাঁদের পরিচিত জগতেরই প্রতিচ্ছবি।
চ্যাপম্যানের গানের ভাষা ছিল অত্যন্ত সাধারণ, যা সহজেই মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যেত। তাঁর গানে ছিল সাধারণ মানুষের স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা, আর বাঁচার আকুতি। ‘টকিন’ অ্যাবাউট এ রেভোলিউশন’ (Talkin’ About a Revolution) -এর মতো গানগুলো যেন বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলো।
আশির দশকে, সঙ্গীতের জগৎ ছিল বেশ একঘেয়ে। সেই সময়ে চ্যাপম্যানের গানগুলো যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো। তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘ট্রেসি চ্যাপম্যান’ মুক্তি পাওয়ার পর, অল্প সময়ের মধ্যেই তা সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
এই অ্যালবামের গানগুলো মানুষের রাজনৈতিক চিন্তা, ভালোবাসার অনুভূতি, এমনকি জীবনের দর্শনকেও প্রভাবিত করেছিল। জ্যাডি স্মিথ মনে করেন, চ্যাপম্যানের গানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর সরলতা।
কোনো বাহুল্য ছাড়াই, শিল্পী সরাসরি শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন। তাঁর গানগুলো ছিল সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-বিরহ, ভুল-ত্রুটি—সবকিছুই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত।
চ্যাপম্যানের গানগুলো শুধু বিনোদনমূলক ছিল না, বরং সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, যেমন—দারিদ্র্য, নিপীড়ন, নারী নির্যাতন—তুলে ধরেছিল। তাঁর কণ্ঠে শোনা যেত, কেন ক্ষুধার্ত শিশুরা আজও খাবার পায় না, কেন শান্তির নামে আজও চলে যুদ্ধ, কেন একজন নারী ঘরেও নিরাপদ নয়।
জ্যাডি স্মিথের মতে, ট্রেসি চ্যাপম্যান শিল্পী হিসেবে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রচারের আলোয় না এসেও, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রেখেও, মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তাঁর গানগুলো আজও মানুষকে আশা জোগায়, লড়াইয়ের প্রেরণা দেয়।
সম্প্রতি ট্রেসি চ্যাপম্যানের প্রথম অ্যালবামটি আবার “ভিনাইল”-এ (vinyl) প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁর সঙ্গীতের প্রতি আজও মানুষের ভালোবাসার প্রমাণ। তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান