যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে গাড়ি তৈরির ব্যবসায় জটিলতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা থেকে সরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে গাড়ির বাজারে।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, বৃহস্পতিবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব গাড়ি, হালকা ট্রাক ও যন্ত্রাংশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ গাড়ির শিল্পের জন্য ‘বিধ্বংসী’ হতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া ১ কোটি ৬০ লক্ষ গাড়ির প্রায় অর্ধেকই আমদানি করা হয়েছে, যার মোট মূল্য ছিল প্রায় ৩৩০ বিলিয়ন ডলার।
তবে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা অনুযায়ী শুল্ক কার্যকর হবে কিনা, অথবা এতে কোনো ছাড় বা পরিবর্তন আনা হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ‘অ্যান্ডারসন ইকোনমিক গ্রুপ’-এর (এজিই) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ইলহান গেকিল বলেন, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ট্রাম্পের নীতিগুলো সংরক্ষণবাদী, যা যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের মুক্তবাজার ও অবাধ বাণিজ্যের ধারণার বিপরীত।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘এখন সেই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। কোম্পানিগুলোকে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হবে।’
জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই এবং কিয়াসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি প্রস্তুতকারক এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের উৎপাদন বাড়াতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে মনে করছেন, শুল্কের কারণে প্রস্তুতকারকরা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে বাধ্য হবে—ট্রাম্পের এমন যুক্তি সঠিক। তবে গেকিলের মতে, পুরো বিষয়টি এত সরল নয়।
গাড়ি প্রস্তুতকারকদের বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব তুলে ধরে গেকিল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাজারের আকার বিচারে এখনো সেরা, যা বিশ্বব্যাপী গাড়ির বাজারের প্রায় ২৫ শতাংশ।’ তবে, অনেক উৎপাদনকারী কম দাম এবং সস্তা পণ্যের সুবিধা নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে উৎপাদন সরিয়ে নিয়েছিল। এখন যদি উৎপাদন আবার যুক্তরাষ্ট্রেই ফিরিয়ে আনা হয়, তাহলে পণ্যের দাম বাড়বে এবং এর ফলে চাহিদা কমতে পারে।
গেকেলের ধারণা, শুল্ক আরোপের ফলে গাড়ির দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। তিনি বলেন, ‘দাম দ্রুত বাড়বে এবং এর প্রভাব পড়বে বাজারে। উদাহরণস্বরূপ, ৫০ হাজার ডলারের একটি গাড়ির দাম কয়েক বছরের মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, যা হয়তো আর কমবে না।’ তিনি আরও মনে করেন, এর ফলস্বরূপ কর্মসংস্থানও কমতে পারে, যা মূলত আমেরিকান শ্রমিকদের রক্ষা করার ট্রাম্পের লক্ষ্যের বিপরীত।
এজিই-এর আগের এক হিসাবে দেখা গেছে, ট্রাম্পের ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাবিত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে তৈরি হওয়া গাড়ির দাম ৪ হাজার ডলার থেকে বেড়ে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) দাম ১২ হাজার ডলার বা তার বেশি পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই হিসাবের মধ্যে অন্য দেশগুলোর প্রতিশোধমূলক শুল্কের প্রভাব ধরা হয়নি।
এছাড়াও, গত ১২ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়া ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কের কারণে প্রচলিত ইঞ্জিনযুক্ত গাড়ির দাম ২৫০ থেকে ৮০০ ডলার এবং ইভি’র দাম ২ হাজার ৫০০ ডলার বা তার বেশি বাড়তে পারে বলে এজিই জানিয়েছে।
ফোর্ড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিম ফার্লি কর্মীদের এক ইমেইল বার্তায় বলেছেন, ‘শুল্কের প্রভাব আমাদের শিল্পের ওপর উল্লেখযোগ্য হবে—গাড়ি প্রস্তুতকারক, সরবরাহকারী, ডিলার এবং গ্রাহকদের ওপর এর প্রভাব পড়বে।’ যদিও ফোর্ডের বিক্রি হওয়া গাড়ির প্রায় ৮০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়।
গাড়ি শিল্পের ওপর শুল্কের ব্যাপক প্রভাবের কারণ হলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে এই শিল্পের গভীর সম্পর্ক। কানাডার ‘গ্লোবাল অটোমেকার্স’-এর প্রেসিডেন্ট ডেভিড অ্যাডামস বলেন, ‘১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে গাড়ির যন্ত্রাংশ ও গাড়ির অবাধ বাণিজ্য শুরু হয়।’ এরপর ১৯৮৯ ও ১৯৯৪ সালে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়, যা দুই দেশের এবং মেক্সিকোর মধ্যে এই শিল্পকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।
অ্যাডামস আরও বলেন, ‘এই দেশগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু যন্ত্রাংশের উৎপাদনে বিশেষত্ব অর্জন করেছে, যার প্রধান কারণ ছিল উৎপাদন খরচ। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার মুদ্রা সাধারণত মার্কিন ডলারের চেয়ে কম থাকে। এছাড়া, কানাডায় একটি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে, তাই কর্মীদের স্বাস্থ্য বীমার খরচ সাধারণত কোম্পানিগুলোকে বহন করতে হয় না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু কাজ করার চেয়ে কানাডায় করা সস্তা।’
কানাডায় তৈরি একটি গাড়ির অর্ধেকের বেশি যন্ত্রাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, আর মেক্সিকোতে তৈরি গাড়ির ক্ষেত্রে, ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অ্যাডামস বলেন, ‘কানাডার গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করা হলে, তা কার্যত আমেরিকান সরবরাহকারীদের ওপরও শুল্ক আরোপ করার মতো হবে।’
কানাডা ও মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশগুলোও সম্ভবত এর প্রতিশোধ হিসেবে শুল্ক আরোপ করবে, ফলে গাড়ির দাম আরও বাড়বে। অ্যাডামস বলেন, ‘আমরা নিজেদের ক্ষতি করতে চাই না, কিন্তু আমরা যা দেখছি, তাতে সবার ক্ষতি হবে। উচ্চ মাত্রার সমন্বয়ের কারণে এর প্রভাব উভয় দিকেই সমানভাবে পড়বে।’
গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়টি আরও জটিল, কারণ এখানে ‘মার্কিন উপাদান’-যুক্ত যন্ত্রাংশগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক প্রযোজ্য হবে না। গাড়ির উৎপাদনে কাঁচামাল সাধারণত এক জায়গায় যন্ত্রাংশে পরিণত হয়, যা পরে অন্য কোথাও একত্রিত হয়ে একটি বড় যন্ত্রাংশ তৈরি করে। একটি গাড়ির জন্য যন্ত্রাংশগুলো তিন থেকে পাঁচবার সীমান্ত অতিক্রম করে।
অ্যাডামস বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং বিভ্রান্তিকর।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘ট্রাম্প সম্ভবত কানাডার গাড়ি শিল্পকে চান না। কিন্তু সবকিছু যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। এটি স্বল্প মেয়াদে সম্ভব নয়। আমরা এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান চাই, যা শুধু গাড়ি শিল্পে নয়, উত্তর আমেরিকার অর্থনীতিতেও স্থিতিশীলতা আনবে, যাতে আমরা ব্যবসা করতে পারি।’
অ্যাডামসের মতে, এই সমাধানে মেক্সিকোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কারণ বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি শিল্পের জন্য একটি কম খরচের অঞ্চলের প্রয়োজন, যেখানে উৎপাদনের শ্রম-নিবিড় অংশগুলো সম্পন্ন করা যায়। তিনি বলেন, ‘বর্তমান চ্যালেঞ্জের একটি অংশ হলো, ট্রাম্প গাড়ি শিল্পকে একটি আমেরিকান শিল্প হিসেবে দেখছেন, উত্তর আমেরিকান শিল্প হিসেবে নয়।’
বর্তমানে, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে এই খাতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল ও অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ব্রেট হাউসের মতে, শুল্কের জন্য ট্রাম্পের কিছু যুক্তি ‘ভুল তথ্যের’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের তথাকথিত ডেটা সম্পূর্ণ ভুল… এবং এটি স্পষ্ট করে তোলে যে এই শুল্কগুলো আসলে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ছিল।’
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা