ঐতিহাসিক পথ ধরে: বিশ্বজুড়ে পুরোনো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের ঢেউ
বহু বছর আগে, যখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পায়ে হাঁটা পথ, মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেত এই পথ ধরেই। সময়ের সাথে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই পথগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল।
তবে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আবার পুরোনো সেই পথগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি, এই পথগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি আর অর্থনীতির বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চীনের ইউনান প্রদেশের কথা ধরুন। এখানকার সংকীর্ণ গিরিখাত আর খাড়া পাহাড়ের কারণে একসময় হেঁটে যাওয়া পথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই অঞ্চলের মেই ঝাং-এর শৈশব কেটেছে এই পথগুলোর সাথেই।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার এবং ‘ওয়াইল্ড চায়না’ নামক ভ্রমণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ঝাং-এর মতে, এই পথগুলোই মানুষের জীবনযাত্রা গড়ে দিয়েছে। আধুনিকায়নের ফলে অনেক পুরোনো পথ নষ্ট হয়ে গেলেও, বর্তমানে সেগুলোকে নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে।
এর ফলে পর্যটকেরা সেই সব পথে হেঁটে যেতে পারছে, যে পথে একসময় তাদের পূর্বপুরুষরা হেঁটেছেন।
চীনের ‘টি হর্স রোড’ তেমনই একটি পথ, যা এক হাজার বছরের পুরনো। একসময় এই পথটি ইউনানের চা বাগান থেকে তিব্বতের বাজারে পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো।
সময়ের সাথে এটি প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। ঝাং-এর উদ্যোগে এটিকে আবার পায়ে হাঁটা পথের উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
এই পথের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে এবং গ্রামীণ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে চান। ঝাং মনে করেন, এই পথগুলো প্রকৃতির সাথে, ঐতিহ্যের সাথে এবং সংস্কৃতির সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপন করে।
শুধু চীন নয়, এই ধরনের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কাজ এখন বিশ্বজুড়ে হচ্ছে। সুইডেন ও নরওয়ের গভীর অরণ্যে ১৪৯ মাইল দীর্ঘ ‘ফিনস্কোগলেডেন’ পথটি ১৭ শতকের ফিনিশ অভিবাসীদের পথ অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে।
জর্ডানের মরুভূমিতে ‘ওয়াদি রাম ট্রেইল’ পুরনো বাণিজ্য পথ এবং হজযাত্রার পথগুলোকে একত্রিত করেছে। যুক্তরাজ্যের ‘স্লো ওয়েজ’ প্রকল্পের অধীনে, প্রতিটি শহরের মধ্যে পায়ে হাঁটা পথ তৈরি ও চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
নেওলিথিক যুগ থেকে ব্যবহৃত হওয়া পথগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত। ভুটানে, ২০১৬ শতকের বৌদ্ধ তীর্থযাত্রার পথ ধরে তৈরি হয়েছে ২৫০ মাইল দীর্ঘ ‘ট্রান্স-ভুটান ট্রেইল’।
ঐতিহাসিক পথ ধরে হাঁটা প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার চেয়েও বেশি কিছু। সুইডেনের মালমো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানিয়েল সভেনসন-এর মতে, এই পথগুলো ইতিহাসের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট তুলে ধরে।
এগুলো সেই জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে ধীরে চলাই ছিল স্বাভাবিক।
ঐতিহ্যবাহী পথগুলো স্থানীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভুটানের ‘ট্রান্স-ভুটান ট্রেইল’-এর সংস্কারের ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন পর্যটকদের জন্য তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করছেন, ক্যাফে ও ছোট রেস্টুরেন্ট খুলছেন।
জর্ডানের বেদুঈন সম্প্রদায়ের মানুষেরা পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করে তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখছেন।
ঐতিহাসিক পথগুলো হলো এক একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এগুলো প্রকৃতির মাঝে টিকে থাকে, যদি না সেগুলোর যত্ন নেওয়া হয়।
তাই, এই পথ ধরে ভ্রমণ করা মানে শুধু ইতিহাসকে খুঁজে ফেরা নয়, বরং সেই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করা।
তথ্য সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।