মায়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্প: ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের আহাজারি, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
মায়ানমারে আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পরেও সেখানকার বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ভবন ধসে পড়ছে। এর ফলে উদ্ধারকর্মীদের জীবন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা এখনো চলছে, তবে জীবিতদের পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। সামরিক জান্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত ২,৭০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, এবং এখনো বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে হলেও, দেশটির সামরিক রাজধানী নাইপিদোতে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এক ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। ভূমিকম্পের ১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় পর তাকে উদ্ধার করা হয়।
ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে কংক্রিটের স্তূপ থেকে বের করে আনা হয়। এমন অলৌকিক ঘটনা নিঃসন্দেহে আশা জাগায়।
এর আগে, নাইপিদোতে ৬২ বছর বয়সী এক নারীকেও ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মিয়ানমারের ডেপুটি প্রধান এলেনা ভুওলো এই পরিস্থিতিকে ‘সংকটের মধ্যে সংকট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সাহায্য পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হলেও, সেখানে নানা ধরনের বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। মানবিক সাহায্য দ্রুত দুর্গতদের কাছে পৌঁছানো জরুরি, তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের কারণে অনেক জায়গায় ত্রাণ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে, চীনের উদ্ধারকারী দল সোমবার চারজনকে—যাদের মধ্যে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু ও এক গর্ভবতী নারীও ছিল—ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত উদ্ধার করেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ভূমিকম্পের কারণে দুর্বল অবকাঠামো সম্পন্ন ভবনগুলো এখনো ধসে পড়ছে, যা উদ্ধার অভিযানকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
ভূমিকম্পের কয়েক দিন পর, মান্দালয়ে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে দুটি হোটেল ধসে পড়েছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মিয়ানমার বিষয়ক পরিচালক মাইকেল ডানফোর্ড বলেছেন, “ভূমিকম্পের কারণে এখনো অনেকে খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায় বা পার্কে ঘুমাচ্ছেন। তারা তাদের ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।
ফলে তাদের কাছে পৌঁছানো এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
মানবিক সংস্থাগুলো জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য পাঠানোর ওপর জোর দিচ্ছে, বিশেষ করে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে।
ভূমিকম্পের আগে থেকেই, চার বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে এবং স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি সাগাইং শহরে, বাসিন্দারা জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী ও খাবারের জন্য হাহাকার করছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সঙ্গে কথা বলার সময় স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেখানে বডি ব্যাগ, টর্চলাইট ও মশার কয়েলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
এছাড়া, সামরিক বাহিনী সাগাইং থেকে মান্দালয়ের দিকে যাওয়া হালকা যানগুলোর ওপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, “সেনাবাহিনী ত্রাণ সরবরাহের ওপর কড়া নজর রাখছে, এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন এলাকা থেকে আসা ত্রাণ পরীক্ষার জন্য বেশি সময় লাগছে।
২০২১ সালে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
যদিও জান্তা সরকার সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ বিতরণে তাদের সীমাবদ্ধতার সমালোচনা করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক ব্রায়নি লাউ বলেছেন, “জান্তা সরকারকে অতীতের খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে দ্রুত মানবিক সাহায্য পৌঁছায়।
এই পরিস্থিতিতে, মিয়ানমারের একটি প্রধান বিদ্রোহী জোট উদ্ধার কার্যক্রম সহজ করার জন্য সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে।
‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা জরুরি ভিত্তিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য দ্রুত ও কার্যকরভাবে মানবিক সহায়তা দিতে চাই।
চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের উদ্ধারকারী দলসহ আন্তর্জাতিক দলগুলো বর্তমানে মিয়ানমারের উদ্ধার কাজে সহায়তা করছে।
মঙ্গলবার সকালে ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দুটি ভারতীয় নৌজাহাজ ইয়াঙ্গুনে পৌঁছেছে।
তবে মানবিক কর্মীরা সতর্ক করে বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে তহবিলের অভাবে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়কারী মারকোলুইগি করসি বলেছেন, “মিয়ানমারের এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত এবং দেশটির জনগণকে সমর্থন করা উচিত।
মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ছিল না।
বর্তমানে, মানবিক সহায়তা পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাঁচ শতাংশেরও কম পাওয়া গেছে।
শুক্রবার আঘাত হানা এই ভূমিকম্পের প্রভাব প্রতিবেশী থাইল্যান্ডেও পড়েছে।
দেশটির রাজধানী ব্যাংককে অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছে।
এর মধ্যে একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবন ধসে পড়ায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন