গর্ভাবস্থায় কিছু রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এমনই একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণায়, প্লাস্টিক ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত হওয়া ‘ফথ্যালেটস’ নামক রাসায়নিক উপাদানটির সঙ্গে শিশুদের স্নায়ু বিকাশের সংযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় ফথ্যালেটসের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের শিশুদের মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদানের পরিমাণে পরিবর্তন দেখা গেছে। এর ফলে শিশুদের মনোযোগ, আবেগ প্রকাশ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, টাইরোসিন, ট্রিপটোফ্যান এবং সেরোটোনিনের মতো উপাদানগুলোর কম উপস্থিতি শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
এই গবেষণার প্রধান লেখক, এমরি ইউনিভার্সিটির পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. ডংহাই লিয়াং জানিয়েছেন, “গবেষণায় আমরা দেখেছি, মায়েদের শরীরে ফথ্যালেটসের উপস্থিতি সরাসরি তাদের শিশুদের মধ্যে মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে।” এই গবেষণাটি *নেচার কমিউনিকেশনস* জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ফথ্যালেটস আসলে কী? এটি এমন একটি রাসায়নিক উপাদান যা প্লাস্টিককে নরম ও নমনীয় করতে ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থ খাদ্য প্যাকেজিং, খেলনা, প্রসাধন সামগ্রী, এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির বিভিন্ন পণ্যে পাওয়া যায়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, ফথ্যালেটস শুধু শিশুদের জন্যই নয়, বরং প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এটি হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে, যা গর্ভধারণে সমস্যা, শিশুদের জন্মগত ত্রুটি, এমনকি ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় ফথ্যালেটসযুক্ত পণ্যের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের শিশুদের মধ্যে মনোযোগের অভাব এবং অতিমাত্রায় চঞ্চলতা দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ফথ্যালেটসের কারণে মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাসায়নিক উপাদানের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে, যার ফলস্বরূপ শিশুদের মধ্যে এমন আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফথ্যালেটসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে এবং ফথ্যালেটস-মুক্ত পণ্য ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
খাদ্য সংরক্ষণে কাঁচ, স্টেইনলেস স্টিল বা সিরামিকের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রসাধন সামগ্রী কেনার সময় ‘ফথ্যালেট-ফ্রি’ লেবেল দেখে কিনতে হবে। এছাড়া, ঘরের বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা উন্নত করা এবং নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করার মাধ্যমেও ফথ্যালেটসের প্রভাব কমানো সম্ভব।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পরিবেশগত ঝুঁকির গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. লিওনার্দো ট্রাসান্ডে বলেন, “প্লাস্টিকের কারণে সৃষ্ট রোগের বোঝা প্রতি বছর শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই গবেষণা প্লাস্টিকের মধ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য যে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তার আরও একটি প্রমাণ।”
বর্তমানে, অনেক প্রস্তুতকারক ফথ্যালেটসের বিকল্প হিসেবে নতুন প্লাস্টিক উপাদান তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তবে ড. ট্রাসান্ডে সতর্ক করে বলেন, নতুন উপাদানগুলোও নিরাপদ কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই গবেষণার মাধ্যমে, গর্ভাবস্থায় মায়েদের স্বাস্থ্যের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে। একইসঙ্গে, প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে এবং ফথ্যালেটস-মুক্ত পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করার গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন